সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

বিগো-লাইকির আড়ালে শত কোটি টাকা পাচার

নিজস্ব প্রতিবেদক

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর এই অভিযানের শুরুতেই উঠে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য। ভিডিও স্ট্রিমিং অ্যাপ ‘লাইকি’ ও ‘বিগো লাইভ’র মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশ থেকে প্রতি মাসে শতকোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বিনোদনের আড়ালে হচ্ছে দেহ ব্যবসা। ছড়ানো হচ্ছে আপত্তিকর ভিডিও। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এসব তথ্য দিয়ে বলেছে, লাইকির বাংলাদেশ শাখার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশ শাখার শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা একজন বিদেশি নাগরিক। এরা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে ‘লাইকি’ ও ‘বিগো লাইভ’ ব্যবহার করে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুর দিকে অ্যাপস দুটি সামাজিক যোগাযোগ ও বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন ব্যবহার হচ্ছে ভয়ংকর সব অপরাধের প্ল্যাটফরম হিসেবে। তাদের টার্গেট দেশের তরুণ আর যুব সমাজ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তরুণীদের মাধ্যমে তাদের লাইভে আড্ডায় এনে অশ্লীলতায় মেতে ওঠে। সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীর ওপর চালানো নির্মম যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর শুরু হয় তোলপাড়। টিকটকে মডেল হিসেবে উপস্থাপনের প্রলোভন দেখিয়ে ওই তরুণীকে ঢাকা থেকে বেঙ্গালুরুতে কার্যত পাচার করা হয়েছিল। এ কান্ডে মারাত্মক সমালোচনা শুরু হয় লাইকি, টিকটক, বিগোর মতো অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলো নিয়ে; বিতর্কিত এসব অ্যাপ বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করে সংশ্লিষ্ট মহল। এর পরই শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বিদেশিসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এরা হলেন মোস্তফা সাইফ রেজা (২৬), মো. আরিফ হোসেন (২৭), এস এম নাজমুল হক (২৭), আসমা উল হুসনা সেঁজুতি (২৮) ও অজ্ঞাত একজন বিদেশি নাগরিক।

লাইকি ও বিগো দিয়ে যেভাবে অর্থ পাচার : সিআইডির সাইবার পুলিশ জানায়, গ্রেফতার বিদেশি নাগরিক বিগো লাইভ ও লাইকির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। বাংলাদেশি নাগরিক মোস্তফা সাইফ রেজা বিগোর বাংলাদেশি অ্যাডমিন। মো. আরিফ হোসেন বাংলাদেশে বিভিন্ন মেয়েদের মাসিক বেতনে চাকরি দিয়ে বিগো লাইভের সঙ্গে যুক্ত করতেন। এস এম নাজমুল হক ভার্চুয়াল মুদ্রা ডায়মন্ড বিক্রির অন্যতম প্রধান বাংলাদেশি এজেন্ট এবং আসমা উল হুসনা সেঁজুতি বিগো লাইভের প্রধান অ্যাডমিন। অ্যাডমিনরা মাসে ১ লাখ টাকা করে বেতন পেতেন। বিগো লাইভ ও লাইকিতে সাধারণত দেশের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভিডিও স্ট্রিমিং করে। বিগো লাইভ অ্যাপে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি ব্রডকাস্টার আইডি ও অন্যটি সাপোর্টার আইডি বা সেন্ডার আইডি। ব্রডকাস্টার আইডি ব্যবহার করে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিং করে। এই ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে কথিত বিনোদনের আড়ালে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এ ছাড়াও সাপোর্টার আইডি বা সেন্ডার আইডির মাধ্যমে যারা ভিডিও স্ট্রিমিং করত, বিনিময়ে তাদের ডিজিটাল কয়েনসদৃশ ডায়মন্ড গিফট করা হতো। পরবর্তীতে এই ডায়মন্ড টাকায় রূপান্তরের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত। তাদের টার্গেট মূলত দেশের যুব সমাজ এবং বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। লাইভ স্ট্রিমিংয়ে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার প্রলোভনে অ্যাপে ঢোকেন সাধারণ ব্যবহারকারীরা। তার জন্য ডায়মন্ড নামে একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা কিনতে হয় ব্যবহারকারীদের। সাধারণত বাংলাদেশে ব্যবহৃত মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এই ডায়মন্ড কেনা যায়। সেই মুদ্রা উপহার হিসেবে দিয়ে আড্ডায় যুক্ত হতে পারেন ব্যবহারকারীরা। যে যত বেশি ডায়মন্ড উপহার পান, লাইভে তিনি তত বেশি অশ্লীলতা করেন। মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের ডিআইজি জামিল আহমেদ গতকাল বলেন, ডায়মন্ড সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন এজেন্সি। এরকম একাধিক এজেন্ট বাংলাদেশে রয়েছে। এসব এজেন্সির প্রত্যেকের একাধিক পেমেন্ট গেটওয়ে রয়েছে। সাধারণত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব এজেন্সির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। সাধারণ ব্যবহারকারীরা এজেন্সির পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ প্রদান করে ডায়মন্ড কেনেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি লক্ষাধিক অ্যাপ ব্যবহারকারী ও প্রবাসী বাংলাদেশি অনলাইন ব্যাংকিং, হুন্ডি, ভার্চুয়াল মুদ্রা ও ব্যাংকের মাধ্যমে ডায়মন্ড কিনছেন। বাংলাদেশি এজেন্সিগুলো ডায়মন্ড কিনে আনে বিদেশি অ্যাডমিনদের কাছ থেকে। এসব এজেন্সি বিভিন্ন অবৈধ মাধ্যম ব্যবহার করে বিদেশে অর্থ পাচার করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতি মাসে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।’

নেপথ্যে যারা : সাইবার পুলিশ জানায়, গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেকের নাম এসেছে এবং তাদের বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের অ্যাকাউন্টে গত এক বছরে প্রায় শতকোটি টাকারও বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেফতার নাজমুলের কাছ থেকে ২টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ, ১টি প্রাইভেট কার, বিভিন্ন ব্যাংকের ৭টি ক্রেডিট কার্ড, বিভিন্ন ব্যাংকের ৬টি চেকবই, নগদ ৫০ হাজার ৪৬০ টাকা উদ্ধার করা হয়। আরিফ হোসেনের কাছ থেকে ২টি মোবাইল ফোন, ১টি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। মোস্তফা সাইফ রেজা ও আসমা উল হুসনা সেঁজুতির কাছ থেকে ৪টি মোবাইল ফোন ও ২টি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। ডায়মন্ড কীভাবে কেনা হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি জামিল আহমেদ বলেন, ‘বিগো লাইভ থেকে মেসেজ দিয়ে অথবা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে ডায়মন্ড কেনা সম্ভব।’ গ্রেফতারকৃত এস এম নাজমুল হক মূলত বিদেশি এজেন্সির মাধ্যমে ডায়মন্ড কেনাবেচা করতেন। সিআইডি এসব অ্যাপ বন্ধের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, লাইকি ও বিগো লাইভ অ্যাপ বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমরা নিয়ন্ত্রণকারীদের এসব বিষয়ে নজরে আনব। এ ছাড়া আমরা এসব অ্যাপ সার্বক্ষণিক নজরদারি করছি। যারা অশ্লীল ভিডিও দিচ্ছে, তাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এসব অ্যাপের অফিস আমাদের দেশে খোলার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব।’ এক প্রশ্নের জবাবে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের স্বার্থে আপাতত ব্যাংকগুলোর নাম বলছি না। তবে কোন কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা লেনদেন হয়েছে, তা আমরা তদন্ত করছি।

সর্বশেষ খবর