শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

শুধু মেগা প্রকল্পে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে না

মানিক মুনতাসির

শুধু মেগা প্রকল্পে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে না

এম এম আকাশ

শুধু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে না। এর জন্য সবার আগে মানুষকে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি কেনাকাটাসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি কমিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সুশাসন। এর জন্য প্রয়োজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক (ক্যাপিটাল) পানিশমেন্ট, যা অন্যদের একটা সিগন্যাল দেবে। আগামী বাজেটে টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটালে তা হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। একক সোর্স থেকে ভ্যাকসিন ক্রয় প্রশ্নে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তবে সেটি দ্রুত রিকোভারিও করা গেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রসঙ্গে এম এম আকাশ বলেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বিষয়টা দেখতে হবে বিশদভাবে। এখানে

সরকারি তথ্যমতে, আমাদের প্রবৃদ্ধি আগে ছিল ৭ শতাংশ। এখন সেটি ৫ শতাংশ। সুতরাং সরকারি পরিসংখ্যান যদি সঠিক হয় তাহলে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে করোনা পরিস্থিতি খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। প্রবৃদ্ধি খুব একটা কমেনি। অনেক দেশের তুলনায় এদিক থেকে আমরা ভালো আছি। সুতরাং কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে ইকোনমি রিকোভারি হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেটি এটির ভিতরে লুকিয়ে আছে সেটি হলো- এ সময় বড়লোকেরা অনেক টাকা উপার্জন করে আরও অনেক ওপরে উঠে গেছেন। আর গরিবেরা আরও গরিব হয়েছেন। আবার নতুন গরিবও তৈরি হয়েছে। আগে দরিদ্রের হার ছিল ২০ শতাংশ। এখন সেটি হয়ে গেছে ৪০ শতাংশ। সুতরাং আগের ইনকু¬সিভ গ্রোথ যতটা ছিল, এর মাত্রা কমে গিয়ে আবার ইক্সক্লুসিভ গ্রোথের মাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। ফলে গড়টা বেশ ভালো দেখাচ্ছে। কিন্তু গড় তো সব সময় ফাঁকিঝুঁকির ব্যাপার। ধরুন আমার অর্ধেক শরীর চুল্লিতে আর অর্ধেক শরীর ডিপ ফ্রিজে ফলে আমি নাতিশীতোষ্ণ। কিন্তু এটি কি আদৌ আমার জন্য স্বস্তিদায়ক? নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। এখন গার্মেন্ট সেক্টরটা একটু ভালো। সেটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির রিকোভারিটার কারণে। সেটি আগে রিকোভারি হয়েছে। অর্ডারগুলো নতুন করে প্লেস হয়েছে। ফলে আমাদের রপ্তানিটা কিছুটা ভালোর দিকে যাচ্ছে। অন্য দেশে শ্রমিক ও পণ্যের চাহিদা নতুন করে কিছুটা তৈরি হয়েছে। সুতরাং আমাদের পণ্য ও শ্রমিকদের বাজার কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং যারা শ্রমিক ও পণ্য পাঠান সেগুলোর তেমন পরিবর্তন নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বিদেশি কোনো বিনিয়োগ আসছে না। বাইরে থেকে বিনিয়োগ আসছে না। এর কারণ হলো, ইকোনমিক জোনসহ আমরা যেসব অবকাঠামো তৈরি করছি, এখানে নানা রকম গভর্নেন্সগত সমস্যা। এখানে ইউটিলিটি সার্ভিস পেতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। নতুন বিনিয়োগের শিল্প স্থাপনে ঘুষ দিতে হয়। এমনকি সরকার এখানে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও বিনিয়োগ তেমন একটা আসছে না। সেটি যদি আসত, তাহলে আমাদের গ্রোথ আরও অনেক বাড়ত। তাহলে প্রশ্ন হলো, গ্রোথ যেটি হচ্ছে, সেটি কোথা থেকে আসছে, এটি মূলত দু-তিনটি জায়গা থেকে হচ্ছে। এর মধ্যে কৃষি, রেমিট্যান্স ও গার্মেন্ট খাত। মূলত এই তিনটি সেক্টর থেকেই গ্রোথ আসছে। এর বাইরে আরও দু-একটি সেক্টর আছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সার্ভিস সেক্টর এখনো অচল। যেমন হোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ, পরিবহন বন্ধ, পর্যটন বন্ধ। এ দুটোতেই বেশি লোক কাজ করে থাকে। কিন্তু এগুলো তো এখনো বন্ধ। ফলে শুধু ঢাকা শহরের অবস্থাই একটু ভালো। বাকি সব বাজে অবস্থায় আছে। বিশেষ করে বর্ডার ডিস্ট্রিক্টগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। এর বাইরে এসএমই সেক্টর থেকে ভালো একটা গ্রোথ আসতে পারত। সেটি আসছে না। এখানে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। কিন্তু সেটি বিতরণ হয়নি। কারণ এখানে ক্রেডিট গ্যারান্টি নেই। ফলে ব্যাংকগুলো এসবে এগিয়ে আসছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট গ্যারান্টি দিতে চেষ্টা করছে কিন্তু সেটি এখনো হয়নি। নতুন দরিদ্র ও বেকারদের জন্য কী করণীয় এমন প্রশ্নে অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, এখানে সবচেয়ে বেশি মজায় আছেন সরকারি খাতের চাকরিজীবীরা। আর প্রাইভেট সেক্টরসহ শ্রমজীবী, দিনমজুররা ধুঁকছেন। এখানে বেসরকারি খাতের জন্য ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ লাগে। এ জন্য বড় বড় প্রকল্পগুলো ধরতে হবে। মাতারবাড়ী, রামপাল, রূপপুর, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এসবের কাজের গতি বাড়াতে হবে। আবার এখানেও সমস্যা আছে। এসব প্রকল্পে তো বিপুলসংখ্যক বিদেশি শ্রমিক কাজ করেন। যেমন পদ্মা সেতু চীনারা, মেট্রোরেলে জাপানিরা কাজ করছেন। সেখানে তো দেশীয় লোকদের কাজের সুযোগ অনেক কম। তিনি বলেন, সুতরাং মেগা প্রকল্পে যে বিনিয়োগ হয় সেটি দিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি হয় এটি বললে ভুল হবে। হয়তো কিছুটা হয়। তবে এটি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর এসব প্রকল্প ঘিরে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা তৈরি হবে। কলকারখানা হবে। তখন হয়তো কাজের সুযোগও সৃষ্টি হবে। এসব মেগা প্রকল্পে কর্মসংস্থানগত প্রভাবটা পড়বে অনেক দেরিতে। এটি রাতারাতি হবে না। সুতরাং মেগা প্রকল্প দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে না। আরেকটি হলো, মেগা প্রকল্পে যদি দুর্নীতি ও অনিয়ম ঠেকাতে না পারে, তাহলে সেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের প্রভাবটাও অনেক দেরিতে পড়বে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি ব্যাহতও হবে। প্রস্তাবিত বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগামী বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৭ দশমিক ২ শতাংশ যে প্রবৃদ্ধির টার্গেট ধরা হয়েছে, সেটি কোনোভাবেই অর্জন করা সম্ভব হবে না। এটি আরও কম হবে। গত বছরও টার্গেটটা হয়নি। সে বছর ৮ এর জায়গায় ৫ হয়েছে। এবারও হয়তো ওই কাছাকাছিই হবে। তবে কতটুকু কমবে আর কতটুকু অর্জিত হবে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। আর বিশাল আকারের বাজেট ঘাটতি সরকারের জন্য অনেক বিপজ্জনক হতে পারে। যদি এটি টাকা ছাপিয়ে পূরণ করতে হয়। আর যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করে, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে করে, তাহলে সেটি সহনীয় হতে পারে। কিন্তু যদি টাকা ছাপিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণ করা হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতিগত সমস্যা হবে এবং সেটি হবে পলিটিক্যাল সমস্যাও। ভ্যাকসিন সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে হযবরল অবস্থা এর সূূত্র ধরে তিনি বলেন, এটি মূলত স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম ও সুশাসনের অভাবে হয়েছে। এটি এখন সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। প্রথম শুরু হলো যে আমরা একটি জায়গা থেকে টিকা আনার প্রক্রিয়া শুরু করলাম, যা মনোপলি ব্যবসা। আমরা সেখানে ফেলও করলাম। অথচ আমরা যদি একটি ডাইভারসিফায়েড করতাম, তাহলে হয়তো অন্য রকম হতো। এখানে আমি যে কোম্পানিকে কাজটা দিলাম সে কোম্পানির লোক হলো আমার পলিটিক্যাল বন্ধু, পলিটিক্যাল অ্যাডভাইজার, আমার পলিটিক্যাল ট্রেজারার। সুতরাং তাকেই দিতে হবে এবং সে এখানে ফেল করেছে। এটি বোকার মতো করেছে আর-কি। আরও তো পলিটিক্যাল বন্ধু ছিল, যারা রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপের সঙ্গে ব্যবসা করে। তাদের যদি কাজটা দিত তাহলে তারা চার জায়গা থেকে চেষ্টা করত। এ ক্ষেত্রে গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে ভারত, চীন ও আমেরিকাকে নিয়ে যে গেম খেলা হয়েছিল, সেটিই খেলা উচিত ছিল টিকা কেনার ক্ষেত্রে। কিন্তু সেটি হয়নি। এক বাস্কেটে সব ফেলে দেওয়ায় এটি আর সফল হয়নি। তবে এটি আবার কুইকলি রিকোভারি করেছে। তবে যেহেতু কাজ দেরিতে শুরু করেছে, তাই এখন দামও বেশি দিতে হচ্ছে। আবার ভ্যাকসিন পেতেও সমস্যা দেরি হচ্ছে। সরকারি কেনাকাটায় যে দুর্নীতি হয়েছে সেটি, আসলে দুর্নীতি তো সবার মধ্যেই আছে। যেমন শিক্ষকের মধ্যে আছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে আছে। এটিকে আসলে আমি এভাবে বলি- অসৎ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ রাজনীতিবিদ। এই তিনের একটা ত্রিভুজ আছে। এই তিনের আবার একটা কোয়ালিশন আছে। ত্রিভুজের তিন বাহু। সব জায়গাতেই আছে। এটি সমাধান করতে হলে ত্রিভুজের তিন বাহুর মধ্যে যারা শীর্ষ। শীর্ষ দুর্নীতিবাজ আমলা, শীর্ষ দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, শীর্ষ দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ। এদের একটা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দিতে হবে। ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বলতে আমি মৃত্যুদন্ড বলছি না। তবে এটা হতে হবে একটা সিরিয়াস পানিশমেন্ট। যেটা একটা সিগন্যাল দেবে। একটা শিক্ষা দেবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেটা বলছেন, যে জিরো টলারেন্স। ঠিক সেটিই প্রমাণ করতে হবে। আর এটি করতে পারলে দুর্নীতি এমনিতেই থেমে যাবে।

সর্বশেষ খবর