রবিবার, ২৭ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ডিজিটাল সাক্ষ্যে বাধা পুরনো আইন

ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত বিচারপ্রার্থীরা - দেড় শ বছর আগের আইনটি দ্রুত যুগোপযোগী করার তাগিদ আইনজ্ঞদের

আরাফাত মুন্না

প্রায় ১০ বছর আগে নেত্রকোনায় শিশু সৈকত অপহরণ ও হত্যা মামলায় ডিজিটাল ডকুমেন্ট (ভিডিওচিত্র, অডিও রেকর্ড ও সিডি) সাক্ষ্য হিসেবে আমলে নেওয়া হয়েছিল অধস্তন আদালতে। তবে ওই সব ডিজিটাল ডকুমেন্ট সাক্ষীর মাধ্যমে যথাযথ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় সাক্ষ্য আইন অনুসারে তা গ্রহণ করেনি হাই কোর্ট। গত বছর সেপ্টেম্বরে হাই কোর্টের দেওয়া এ-সংক্রান্ত রায়ে সাক্ষ্য আইন যুগোপযোগী করে সংশোধনে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

শিশু সৈকত হত্যা মামলাটি একটি উদাহরণ মাত্র। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ও বিকাশের সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধে এর ব্যবহারও বাড়ছে। অনেক অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী খুঁজে পাওয়া না গেলেও প্রযুক্তির কল্যাণে সিসিটিভি ফুটেজ এবং মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও, রেকর্ড করা অডিও, মোবাইল ফোনের কললিস্ট পাওয়া যাচ্ছে। চাক্ষুষ প্রমাণ এসব ইলেকট্রনিক ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড মামলার বিচারের সময় আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করলে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করতে বেগ পেতে হতো না। কিন্তু সাধারণ আইনে করা মামলায় এসব ডিজিটাল সাক্ষ্য বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই প্রায় দেড় শ বছরের পুরনো সাক্ষ্য আইনে।

আইনজ্ঞরা বলেন, ১৮৭২ সালে ইংরেজিতে প্রণীত সাক্ষ্য আইনটির অনেক বাক্য এবং শব্দ অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। এ ছাড়া অতি প্রাচীনকালের পদ্ধতিগত এ আইনের অনেক ধারাও প্রয়োগের অনুপযোগী। তাই দ্রুত আইনটি যুগোপযোগী করে সংশোধন প্রয়োজন। তারা বলেন, প্রতিবেশী ভারতও প্রায় ২০ বছর আগে আইনটি যুগোপযোগী করে সংশোধন করেছে। আমাদের দেশে আইনটি যুগোপযোগী না করায় অনেক সুনির্দিষ্ট ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আইনে তা আমলে নেওয়ার সুযোগ না থাকায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থী।

এদিকে গত বছর আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন পাস করেছে সরকার। ফলে ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই বিচারকাজ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে সাক্ষ্য আইনে ডিজিটাল সাক্ষ্য (অডিও, ভিডিও রেকর্ড, ইমেইল, মেমোরি কার্ড, হার্ডডিস্ক, টেলিগ্রাম, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি) আমলে নেওয়ার সুযোগ না থাকায় ভার্চুয়ালি অধস্তন আদালতে নিয়মিত বিচার কার্যক্রম এখনো শুরু করা যায়নি। গত বছর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন পাসের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, সাক্ষ্য আইন সংশোধনের পর এ আইন অনুযায়ী বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা যাবে। তখন বিচারিক আদালত এই মাধ্যম ব্যবহার করে বিচার, সাক্ষ্য গ্রহণ এবং যুক্তিতর্ক শুনতে ও রায় দিতে পারবে।

এ ছাড়া বিচার কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করতে সরকার ই-জুডিশিয়ারি নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ৩ জুন বাজেট অধিবেশনে বক্তৃতার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্পের আওতায় সারা দেশের বিচারব্যবস্থা ডিজিটালাইজ করা হবে। দেশের প্রতিটি আদালত হবে একেকটি ই-কোর্ট। কিন্তু সাক্ষ্য আইনের সংশোধন ছাড়া এ প্রকল্প করে কোনো লাভ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ভারতীয় উপমহাদেশের আদালতে আইন পরিচালনার জন্য সর্বপ্রথম ১৮৫০ সালে স্যার হেনরি সামার মেইন একটি সাক্ষ্য আইনের খসড়া বিল তৈরি করেন, যা পরে এ উপমহাদেশে ব্যবহারের অনুপযোগী বলে প্রতীয়মান হয়। পরে ১৮৭১ সালে স্যার জেমস ফিটজজেমস ফিস্টফেন নতুন করে একটি খসড়া প্রস্তুত করেন, যা কার্যকর হয় ১৮৭২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে। মূলত সে খসড়া আইনই গুটিকয় সংশোধনসহ এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে বিচারকাজে।

যা আছে সাক্ষ্য আইনে : সাক্ষ্য আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা পরিচালিত ট্রাইব্যুনাল ও আদালতে বিচার পরিচালনায় কীভাবে একজন সাক্ষীর কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে অথবা কী পদ্ধতিতে গ্রহণ করা হবে, কোনটি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয়, কোনটি গ্রহণীয় নয় এসব বিষয় উল্লেখ রয়েছে এ আইনে। তিনটি অংশে বিভক্ত ১৬৭টি ধারাসংবলিত এ আইনে মূলত দুই ধরনের এভিডেন্সের (সাক্ষ্যের) কথা আছে। প্রথমত মৌখিক এবং দ্বিতীয়ত ডকুমেন্টারি।

আইনটি পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, আইনের ধারা ৩-এ ডকুমেন্ট হিসেবে পাঁচটি উদাহরণ দেওয়া আছে। এতে ডকুমেন্ট বলতে কোনো পদার্থের ওপর অক্ষর, অঙ্কন বা চিহ্নের সাহায্যে কিংবা উক্ত পক্ষের একাধিক পন্থায় প্রকাশিত বা বর্ণিত কোনো বিষয়, লিখিত যে কোনো জিনিস, মুদ্রিত, লিথোগ্রাফকৃত, ফটোগ্রাফকৃত সব শব্দই ডকুমেন্ট বা দলিল। কিন্তু এ আইনে ডিজিটাল ক্যামেরা, মোবাইলে ধারণ করা অডিও বা ভিডিও কিংবা অডিও ভিজুয়াল রেকর্ডের কোনো বিষয় উল্লেখ নেই। আইনের উল্লেখ না থাকায় ডিজিটাল সাক্ষ্যের কোনো মূল্য নেই।

তবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলোয়, যেমন স্পেশাল ট্রাইব্যুনালসমূহ, যথা সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, আইসিটি আইন ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ডিজিটাল এভিডেন্স গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ আদালতেরও অনেক নির্দেশনা ও নজির রয়েছে ডিজিটাল এভিডেন্স আমলে নেওয়ার। এ ছাড়া সরাসরি সাক্ষ্য আইনে না থাকলেও জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ৩(১৬) ধারা এবং পেনাল কোডের ২৯ ধারায় ডিজিটাল সাক্ষ্য আমলে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সাক্ষ্য আইনে ডিজিটাল সাক্ষ্য গ্রহণের সুযোগ না থাকায় সাধারণ আইনে করা মামলাগুলোর প্রয়োগ হয় না বললেই চলে।

দ্রুত যুগোপযোগী করার তাগিদ আইনজ্ঞদের : অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ আইনটি দেড় শ বছরের পুরনো। এ আইনটি দ্রুত যুগোপযোগী করে সংশোধনের তাগিদ দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাক্ষ্য আইন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ আইনগুলোয় ডিজিটাল প্রমাণ সাক্ষ্য হিসেবে আমলে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও সাক্ষ্য আইনে সে সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘দেড় শ বছর আগে যখন সাক্ষ্য আইনটি করা হয়েছিল, তার সঙ্গে বর্তমান অবস্থার অনেক পার্থক্য। এখন অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তথ্যপ্রযুক্তি। অনেক অপরাধের অডিও-ভিডিও সামনে আসছে। সাক্ষ্য আইন সংশোধন হলে এসব অডিও-ভিডিও অপরাধ প্রমাণে সুনির্দিষ্ট ডকুমেন্ট হিসেবে কাজে আসবে।’ তবে সাক্ষ্য আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ আইনটি সংশোধন করতে হলে দক্ষ, অভিজ্ঞদের দিয়ে এর ড্রাফট তৈরি করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। জানতে চাইলে হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। বর্তমান সময়ে প্রতিটি অপরাধেই তথ্যপ্রযুক্তি কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকছে। কিন্তু আমাদের প্রচলিত সাক্ষ্য আইনে সুযোগ না থাকায় ডিজিটাল এভিডেন্স বিচারের সময় আমলে নিতে পারছেন না বিচারক।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনটি দেড় শ বছরের পুরনো। এ আইনটি সংশোধন করা এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে সিসিটিভি ফুটেজ আছে, কললিস্ট আছে, কিন্তু সাক্ষীর অভাবে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে।’ আইনটি সংশোধন হলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির পাশাপাশি ন্যায়বিচার নিশ্চিতেও সহায়ক হবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর