মঙ্গলবার, ২৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

বিস্ফোরণে মুহূর্তেই সব লণ্ডভণ্ড

মিলেছে গ্যাসের উপস্থিতি, হাসপাতালে আহাজারি, মর্গে মাতম ১৪টি ভবন ও তিনটি বাস ক্ষতিগ্রস্ত, তিন তদন্ত কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিস্ফোরণে মুহূর্তেই সব লণ্ডভণ্ড

মগবাজারে বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত ভবন -জয়ীতা রায়

ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা মগবাজার ওয়্যারলেস গেট। সড়কে যানবাহনের গতি আটকে আছে যানজটে। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা মানুষের পদচারণায় মুখরিত। দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট ও ফাস্টফুডের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। সবকিছু চলছিল অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক। সন্ধ্যায় হঠাৎ বিস্ফোরণ। প্রকম্পিত হয় গোটা এলাকা। কী থেকে কী হচ্ছে, তা কেউ জানতে পারছিল না। কিন্তু সেই ভয়াবহ এক বিস্ফোরণেই পাল্টে যায় গোটা এলাকার চিত্র। মুহূর্তেই ল-ভ-। তিনতলা ভবনের একটি অংশ ধসে পড়ে। আশপাশের বহুতল ভবনগুলোর কার্নিশ জানালা কাচ ভেঙে নিচে পড়তে থাকে। রাস্তায় দাঁড়ানো যাত্রীবাহী তিনটি বাস হয় চুরমার। যেন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত কোনো এক নগরী। গত রবিবার এমন ভয়ঙ্কর এক সন্ধ্যার মুখোমুখি হয়েছিল  সেখানকার বাসিন্দারা। বহুতল ভবনের বাসিন্দারা বলেছেন, ভেবেছিলাম ভূমিকম্প হচ্ছে। তাই দ্রুত ভবন থেকে নেমে আসি। কিন্তু নেমে এসেই দেখতে পাই রক্তাক্ত মানুষের মিছিল। কোনো শব্দ যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে, এবার তা বুঝতে পেরেছি। মগবাজারের এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতবাক সবাই। ঘটনাস্থল শরমা হাউসের নিচতলায় হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, হাইড্রোকার্বন হলো প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি উপাদান। তবে শুধু গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনা অস্বাভাবিক। মগবাজারে শরমা হাউসে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শনের পর আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, এখন পর্যন্ত কীভাবে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। শুধু গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনা অস্বাভাবিক। তদন্ত সাপেক্ষে আসল কারণ জানা যাবে। তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করছেন। প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থলে হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সঠিক কারণ জানতে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর, বিস্ফোরক অধিদফতরের এবং পুলিশের পক্ষ থেকে কমিটি তিনটি গঠন করা হয়।

গত রবিবার সন্ধ্যায় বিকট শব্দের এ বিস্ফোরণে সাতজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হয়। এ ছাড়া ১২টি বাণিজ্যিক ভবন ও দুটি আবাসিক ভবন এবং তিনটি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস।

বিস্ফোরণের পর গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, মগবাজারের ভবনগুলোর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বিস্ফোরণ এতটাই প্রকট ছিল যে আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনাও কেঁপে ওঠে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন ধরে গেলে দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে সবাই। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট। তবে বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে এখনো রয়েছে রহস্য। কোনো পক্ষই নিশ্চিত করে কিছুই জানাতে পারেনি। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন আইজিপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট, বিদ্যুৎ, তিতাস গ্যাস ও বিস্ফোরক পরিদফতরের কর্মকর্তারা।

বিস্ফোরণের ধাক্কায় রাস্তার উল্টো দিকে আড়ং, বিশাল সেন্টার, রাশমনো হাসপাতালসহ আশপাশের ডজনখানেক ভবনের কাচ চৌচির হয়ে ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাস্তায় থাকা অন্তত তিনটি বাস। ৭৯ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের পুরনো তিন তলা ওই ভবনের দোতলায় সিঙ্গারের বিক্রয় কেন্দ্র ছিল। ভবনটির একাংশ ধসে পড়েছে। দেয়াল ভেঙে পণ্যের কার্টন বেরিয়ে পড়তে দেখা যায়। নিচতলায় খাবারের দোকান শরমা হাউস ও বেঙ্গল মিটের বিক্রয় কেন্দ্র ছিল, যা মোটামুটি মিশে গেছে। লোহার গ্রিল, আসবাবপত্র, ভবনের বিভিন্ন অংশ ছিটকে এসেছে রাস্তায়। এমনকি বেঙ্গল মিটের ভিতরে থাকা বড় একটি জেনারেটর বেরিয়ে এসেছে রাস্তার ওপরে। যে কোনো সময় পুরো ভবন ধসে পড়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। প্রত্যক্ষদর্শী সোলায়মান কবির জানান, যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার অল্প কিছু দূরে তিনি একটি বাসে ছিলেন। বিকট শব্দে বিস্ফোরণের কথা শুনে বাস থেকে নেমে দৌড়ে আসেন ঘটনাস্থলে। তার ভাষ্যে, ‘পেছনে বাসের ভিতরে আছিলাম। নাইম্যা দৌড়াইছি, ফ্রেন্ডরে আমার শার্টটা দিয়া এই জায়গায় আসছি। আইসা দেখি এইখানে দুইটা বাস, আর ওই পাশে একটা বাস। এইহানে মানুষ এইখান সেইখানে রাস্তায় পইড়া ছিল। আমরা মানুষ ধরাধরি কইরা মেডিকেলে নিছি।

বিকট শব্দের এ বিস্ফোরণে ১২টি বাণিজ্যিক ভবন ও দুটি আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। একটি ভবনে ছিল অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘অপরাজেয় বাংলা’র কার্যালয়। যে ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো হলো- আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর ভবন, রাশমনো স্পেশাইলাইজড হাসপাতাল, নজরুল শিক্ষালয়, আড়ং শো-রুমের ভবন, বিশাল সেন্টার, ডম-ইনোর বাণিজ্যিক ভবন, বেস্ট বাই শো-রুমের ভবন, বেঙ্গল ট্রেডস সেন্টার ভবন, ক্যালকাটা ড্রাই ক্লিনার্সের ভবন, মগবাজার প্লাজা, হামদর্দ চিকিৎসা ও বিক্রয় কেন্দ্র এবং ভিশন অ্যাম্পোরিয়ামের শো-রুম থাকা ভবন। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর প্রতিটিই বহুতল। প্রতিটি ভবনে একাধিক দোকানসহ বাণিজ্যিক অফিসের কার্যালয় রয়েছে। বিস্ফোরণে এসব দোকান ও অধিকাংশ অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনাস্থলে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মোহেমা ইসলাম বলেন, আড়ংয়ের কেনাকাটা শেষ করে নিচে নামতে না নামতেই এক বিকট শব্দ। মুহূর্তের মধ্যেই সব কিছু অন্ধকার। ধুঁয়ায় ঝাপসা হয়ে গেল। নিচে এসে দেখি বিল্ডিংয়ের সব থাই গ্লাসের কাচ ওপর থেকে পড়ছে।

হাসপাতালে আহাজারি : দিনাজপুরের একটি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ (২০)। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে বড়। বাবা জসিম উদ্দিন কৃষি কাজ করে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছেন। কৃষক বাবার পক্ষে পুরো পরিবারের ভরণ পোষণ, তিন সন্তানের লেখা-পড়ার খরচ ব্যয় করা নিতান্তই কষ্টসাধ্য। পরিবারের এমন বেগতিক দেখে ছাত্র জীবনেই চাকরির সন্ধান করতে থাকেন রাসেল। ছয় মাস আগে পরিচিত একজনের মাধ্যমে ঢাকায় এসে একটি চাকরিতে যোগ দেন। পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটিয়ে পরিবারের অভাব ঘোচানোর সংগ্রামে ব্যস্ত সময় পার করতেন রাসেল। কিন্তু পরিবারের সুখ দীর্ঘায়িত করতে পারলেন না তিনি। হাল ধরা সেই রাসেলই এখন পুরো পরিবারের জন্য শোকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণে দগ্ধ হন রাসেল। ৯০ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে তিনি এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটপট করছেন। শুধু রাসেল আহমেদ-ই নয়; তার মতো মৃত্যু যন্ত্রণায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন বেঙ্গল মিটের সেলসম্যান ইমরান হোসেন শুভ (২৫), ভ্যানচালক নবী মন্ডল (৩০)-সহ অনেকে। এদেরও ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। দগ্ধ ইমরানের ছোট বোন আইরিন সুলতানা জানান, তার ভাই বেঙ্গল মিটের সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। ইমরানের স্ত্রী তামান্না আক্তারও বেঙ্গল মিটের অন্য শাখায় চাকরি করেন। তারা স্বামী-স্ত্রী মগবাজার এলাকায় থাকতেন। ঘটনার সময় ইমরান অফিসে ছিলেন। তাকে হাসপাতালে আনার পর তার ফোন দিয়ে অপরিচিত একজন কল করে বিষয়টি জানায়। পরে তারা হাসপাতালে ছুটে আসেন। কিন্তু পুরো শরীর পুড়ে যাওয়ায় ভালোভাবে ইমরানকে চিনতেও পারছিলেন না তারা। একই ঘটনায় দগ্ধ ভ্যানচালক নবী মন্ডলের স্বজনরাও হাসপাতালের বারান্দায় বসে চিন্তায় আছেন। তার স্ত্রী পপি আক্তার স্বামীর দগ্ধ হওয়ার খবরে রাজবাড়ী থেকে গতকাল সকালে ঢাকায় আসেন। এসে স্বামীর দগ্ধ শরীর দেখে চিনতে পারছিলেন না তিনি। পরে শনাক্ত করেন। দগ্ধদের মধ্যে এই তিনজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।

ঢামেক মর্গে শোকের মাতম : অ্যাম্বুলেন্স থেকে ব্যান্ডেজে মোড়া একটি লাশ নামানো হচ্ছে মর্গে। লাশের পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন যুবক। কাছে গিয়ে জানা গেল, লাশটি বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত রেডিও ধ্বনির আরজে মোস্তাফিজুর রহমানের। লাশটি মর্গের ভিতরে নেওয়া হলেও পানিতে টলমল করা দৃষ্টিতে সেদিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে নাঈম নামে এক যুবক। সে মোস্তাফিজুরের সঙ্গে একই মেসে থাকে এবং এক সঙ্গে কবি নজরুল সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। জানতে চাইলে নাঈম বলেন, ও খুব ভালো আবৃতি করত। কণ্ঠ ভালো হওয়ায় মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতাম। এখন আর কেউ আবৃতি করে শোনাবে না। সময়মতো খেয়েছি কি না সেই খোঁজও নেবে না। এ সময় পাশে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মোস্তাফিজুরের মাদরাসার বন্ধু আরিফসহ আরও ৩-৪ যুবক। সবার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে শোকের ছায়া। মোস্তাফিজুর গফরগাঁওয়ের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। বর্তমানে শনির আখড়ায় একটি মেসে থাকতেন। ডাক্তার দেখিয়ে ওয়্যারলেসে অফিসে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান নাঈম। মোস্তাফিজুরের মতোই ময়নাতদন্তের জন্য আরও ৩টি লাশ ঢামেক মর্গে নেওয়া হয়। তারা হলেন, মগবাজার আড়ংয়ের সিনিয়র সেলসম্যান জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকার ডা. খয়বার মন্ডলের ছেলে রুহুল আমিন নোমান, ক্ষতিগ্রস্ত আজমেরী বাসের চালক ও মালিক কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের উনকুট গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম মোল্লা (৪৫), প্রাইভেটকার চালক মগবাজার চেয়ারম্যান গলির বাসিন্দা স্বপন (৩৫)। ময়নাতদন্ত শেষে তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে মর্গ সূত্রে জানা গেছে। তাদের স্বজনদের মধ্যেও দেখা যায় শোকের মাতম। এ ঘটনায় নিহত জান্নাত কাকলী ও তার ৯ মাস বয়সী মেয়ে সোবাহানা তাইয়েবার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান।

খোঁজ মেলেনি হারুনের : বিস্ফোরণের পর থেকে হারুন-অর-রশিদ (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। তার মেয়ে হেনা বেগম হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন বাবার খোঁজে। যে ভবনে বিস্ফোরণ হয়, সেখানে তিনি কেয়ারটেকার হিসেবে প্রায় আড়াই বছর ধরে চাকরি করেন। একাই একটি কক্ষে সেখানে থাকতেন বলে জানা গেছে। হারুন-অর-রশিদের মেয়ের জামাই জুলহাস মিয়া বলেন, কাল (রবিবার) রাত থেকে খুঁজতেছি। পাঁচ থেকে সাতটা হাসপাতালে ঘুরছি, পাই নাই। থানায় গিয়ে জানাব। দেখি কী হয়।

সর্বশেষ খবর