বুধবার, ৩০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

জালিয়াতির মাধ্যমে ছাড় নেওয়া বিটুমিন ১৯ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত

মানসম্পন্ন না হওয়ায় ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের চালান আটক

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

জাল সনদ জমা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় নেওয়া সব বিটুমিনই ১৯ ঘণ্টার মধ্যে বন্দরে ফেরত এনেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস দল। জাল সনদ তৈরি করে কাস্টমসকে বোকা বানিয়ে গত সোমবার ড্রামভর্তি ২০ ট্রাক বিটুমিন ছাড় করে নিজেদের গুদামে নিয়ে গিয়েছিল আমদানিকারক ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’। ধরা না পড়লে পর্যায়ক্রমে বাকি বিটুমিনও ছাড় নিয়ে যেত আমদানিকারক। এর আগেই জাল সনদ নিশ্চিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম কাস্টমস আমদানি চালানের সব বিটুমিন আটক করে। একইসঙ্গে ছাড় নেওয়া নিম্নমানের বিটুমিনের চালান ফেরত আনার নির্দেশ দেয়। এরপর গত সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত ১২ ট্রাক এবং গতকাল ভোরে ৫ ট্রাক সর্বশেষ বেলা ১১টা নাগাদ বাকি তিন ট্রাক ফেরত আনা হয়। গত সোমবার বিকাল ৪টা নাগাদ বন্দর থেকে এই বিটুমিন ছাড় হয়। আবার ফেরত আনতে মোট সময় লাগে ১৯ ঘণ্টা। বর্তমানে ওই আমদানিকারকের আনা সব বিটুমিন এখন বেসরকারি কনটেইনার ডিপো ’চিটাগাং কনটেইনার ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি লিমিটেড’ এ আটক আছে।

ইস্টার্ন রিফাইনারির মান পরীক্ষায় ওই সব বিটুমিনই নিম্নমানের এবং ছাড়যোগ্য নয়। নিম্নমানের বিটুমিন বন্দর থেকে ছাড় করতেই মান সনদ জাল করে কাস্টমসে জমা দেয় আমদানিকারকের নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সান শাইন এজেন্সি। জালিয়াতির মাধ্যমে নিম্নমানের বিটুমিন ছাড়ের চাঞ্চল্যকর ঘটনা উদঘাটন করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম। তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধান কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার। বাকি দুজন হলেন একজন উপ-কমিশনার, একজন সহকারী কমিশনার। তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরই আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর আগে ঘটনার ‘নাটের গুরু’ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রামের তাহের চেম্বারের সান শাইন এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা বলেন, ছাড় হওয়া ২০ ট্রাক বিটুমিন পুনরায় ফেরত আনা হয়েছে। ফেরত আনার ক্ষেত্রে তারা নানা গড়িমসি করছিল। এরপরও ফেরত আনতে গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত আমাদের সময় লেগেছে। সব বিটুমিনই অক্ষত অবস্থায় ফেরত আনা হয়েছে।

তিনি বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারির নামে জমা দেওয়া নকল মান সনদও যাচাই-বাছাই করেছে ইস্টার্ন রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ। আমি লিখিতভাবে তা গ্রহণ করেছি।

জালিয়াতি করে ভুয়া সনদ দিয়ে পণ্য ছাড়ের পর ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’-এর সব আমদানিকৃত চালান পরীক্ষার দাবি উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে এভাবেই তারা আগেও নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে বাজারে ছেড়েছে। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, বিটুমিনের মান নিশ্চিতে বাধ্যতামূলক সনদ যাচাইয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এসআরও জারি হয়েছে ২৫ মে থেকে। এরপর আমদানি হয়ে আসা চালানই আমরা কেবল মান সনদ যাচাই করছি। এর আগের চালানের ক্ষেত্রে আমাদের মান যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না। তবে ২৫ মের পর থেকে এ আমদানিকারক এবং অন্য আমদানিকারকের চালান ছাড়ে আমরা বাড়তি সতর্কতা আরোপ করেছি। ল্যাব পরীক্ষায় মান উত্তীর্ণ না হওয়ায় ওই আমদানিকারকের সব বিটুমিন আটক থাকবে- যোগ করেন কাস্টমস কমিশনার। উল্লেখ্য, দেশে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দীর্ঘদিন ধরে এসব বিটুমিন আমদানি হলেও মান নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে অহরহ নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি হচ্ছিল। কোনোভাবেই তা ঠেকানো যাচ্ছিল না। এতে করে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে হাজার কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছিল সরকারের। সর্বশেষ গত ২৫ মে বিটুমিনের মান নিশ্চিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তিনটি নির্ধারিত ল্যাবে মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে। এরপর থেকেই মূলত নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির চক্রটি বিপাকে পড়ে। মান যাচাই বাধ্যতামূলক করার পর এই প্রথম কোনো চালান ধরা পড়ল কাস্টমসের হাতে।

নমুনা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে আমদানিকারক ঢাকার ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’ ভুয়া মান সনদ কাস্টমসে জমা দিয়ে বিটুমিন চালান ছাড় নিতে চেয়েছিল। ৫০ কনটেইনারের মধ্যে ৯টি কনটেইনার ভুয়া সনদ দিয়ে বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছে। কিন্তু কাস্টমসের হাত থেকে শেষ রক্ষা হলো না। ইস্টার্ন রিফাইনারির দেওয়া আসল মান সনদে পুরো চালানই ছাড়ের অযোগ্য। কারণ সেগুলো নিম্নমানের বলেই ল্যাব রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে। নমুনা পরীক্ষায় ‘ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’-এর চালানটি দুটি শ্রেণিতে মান উত্তীর্ণ হয়নি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- পেনিট্রেশনে সেটি ৭২ পয়েন্ট পেয়েছে। কিন্তু চালানটি ৬০-৭০ গ্রেডের মধ্যে থাকতে হবে। অর্থাৎ মান অনুযায়ী ২ পয়েন্ট বেশি। আর সফটেনিং শ্রেণিতেও ঘোষণার চেয়ে কম পয়েন্ট পাওয়া গেছে। এই অবস্থায় সেটি ঘোষিত মান অনুযায়ী হয়নি বলে মত দিয়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারি। অথচ এই মান সনদকে জাল করে একটির পয়েন্ট বাড়িয়ে ও অন্যটির পয়েন্ট কমিয়ে মান উত্তীর্ণ হিসেবে সনদ দিয়েছে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। জাল সনদের সূত্র নম্বর থেকে শুরু করে প্যাড, স্বাক্ষর সবকিছুই জাল করা হয়েছে। জানা গেছে, আমদানিকৃত পণ্যের মান বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা যাচাইয়ের পর সেটি ম্যানুয়ালি এবং ই-মেইলে পাঠানোর নিয়ম আছে। বিএসটিআই এই নিয়ম পালন করলেও কিন্তু ইস্টার্ন রিফাইনারির ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি। এ কারণেই জাল সনদ তৈরির সুযোগ পেয়েছে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। জানতে চাইলে মান সনদ দেওয়া প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির উপ মহাব্যবস্থাপক (মান নিয়ন্ত্রণ) জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সবসময় সরকারিভাবে আমদানিকৃত পণ্যের মান সনদ যাচাই করতাম। এই প্রথম বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নমুনা পরীক্ষা করলাম। প্রথম অভিজ্ঞতার কারণেই আমাদের এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। এরপর থেকে আমরা সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছি।

পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আমরা কাস্টমসে বলেছি একটি চিঠি দিতে। যাতে আমরা ই-মেইলেও মান সনদ পাঠাতে পারি। এতে করে জালিয়াতির সুযোগ থাকবে না। একই সঙ্গে সনদ জাল করার কারণে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। তাই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে আমি ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সুপারিশ করছি- যোগ করেন জাহিদুল ইসলাম।

সর্বশেষ খবর