শিরোনাম
বুধবার, ৩০ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা
আজ বাজেট পাস

জরিমানা বাড়িয়ে কালো টাকা সাদার সুযোগ রেখে অর্থবিল সংসদে পাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান উৎসাহিত করতে আবারও কালো টাকা (অপ্রদর্শিত আয়) সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এজন্য বিনা প্রশ্নে নগদ টাকা নতুন শিল্পে বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার, ফ্ল্যাট ও প্লট, ব্যাংক আমানতসহ বেশ কয়েকটি খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখে অর্থবিল, ২০২১ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাড়ানো হয়েছে জরিমানার পরিমাণ। ৩ জুন সংসদে প্রস্তাবিত অর্থবিলে জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিশেষ সুযোগ দেওয়ার সংশোধনী আনা হয় গতকাল। পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য এ বিল পাস হয়। এ বিল পাসের সময় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। আজ ৩০ জুন জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পাস হওয়ার কথা রয়েছে। ৩ জুন কালো টাকা সাদা করার প্রচলিত নিয়মের বাইরেও বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে জরিমানা ও শর্ত বাড়িয়ে প্রশ্ন ছাড়া বিশেষ সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। পাস হওয়া অর্থবিলে আগামী অর্থবছরে পুঁজিবাজারে প্রশ্নাতীতভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এতে তালিকাভুক্ত শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটসহ পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ইনস্ট্রুমেন্টে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ কর এবং মোট করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা গুনতে হবে এ সুযোগ নিতে। নতুন অর্থবিলে নতুন এসব সুযোগের পাশাপাশি আগের ঘোষণা অনুযায়ী হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং জমি ও ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে এমন সুযোগ থাকছে।

অবশ্য এর আগে ৩ জুন প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারসহ বেশ কয়েকটি খাতে কালো টাকা বিনা প্রশ্নে সাদা করার অবাধ সুযোগ অব্যাহত রাখার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। প্রস্তাবিত অর্থবিলেও তখন এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকলেও কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ শেষ হচ্ছে বলে আলোচনা তৈরি হয়। তবে বাজেট প্রস্তাবের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ রেখে তা বহাল রাখার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগেও তিনি এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে কালো টাকার ব্যাপারে অর্থবিল পাস হওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেছিলেন। এ ছাড়া আরও কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে অর্থবিলে। শিল্পের কাঁচামাল কেনায় ক্রসচেকে লেনদেনের শর্ত শিথিল করে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য অর্থবিল পাস করেছে সংসদ। এ ছাড়া শিল্প খাতে কালো টাকা বিনিয়োগে দেওয়া ‘বিশেষ’ সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। বাজেট ঘোষণার পর মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথকভাবে করপোরেট কর কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আবেদন করে। এনবিআর প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে এ খাতে করপোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিং সেবার করপোরেট কর প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৭ দশমিক ৫০ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এদিকে হোটেল-রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৭ থেকে নামিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাবও অনুমোদন করা হয়েছে। এবারের অর্থবিলে নতুন এসব সুযোগের পাশাপাশি আগের ঘোষণা অনুযায়ী হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এমন সুযোগ থাকছে। সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিং সেবার করপোরেট কর প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৭ দশমিক ৫০ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এবারের অর্থবিলে কর্মীদের বেতন পরিশোধে নতুন নিয়ম আনা হয়েছে। বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশে কর্মীদের বেতন-ভাতা ও সম্মানীর পরিমাণ ১৫ হাজার টাকার বেশি হলে তা ক্রসচেক বা ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে করার বিধান রয়েছে। তা না হলে এ খাতে ব্যয় করা অর্থ আয় হিসেবে দেখানো হয় না। আর আয় হিসেবে গণ্য করলে তা করযোগ্য হয়ে যায়। সংশোধিত অর্থবিলে এ সীমা ১৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার করা হয়েছে। বিনিয়োগ সহজ এবং উৎসাহী করতে শিল্পের কাঁচামাল কেনার ক্ষেত্রে ক্রসচেকের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। বর্তমানে ৫০ হাজার টাকার বেশি কাঁচামাল কিনলে সে ক্ষেত্রে চেকে লেনদেনের বিধান চালু আছে। এটি বাড়িয়ে ৫ লাখ করা হয়েছে। এখন থেকে ৫ লাখের কম টাকার কাঁচামাল কিনলে চেকে লেনদেনের বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে শিল্পোদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রণীত বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ সময় অর্থবিলের ওপর কয়েকজন সদস্যের আনা কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বাকিগুলো কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়। পরে তিনি অর্থবিল পাসের অনুরোধ জানালে স্পিকার তা ভোটে দেন। উপস্থিত সদস্যদের কণ্ঠভোটে পাস হয় অর্থবিল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে সীমিতসংখ্যক আইনপ্রণেতাকে নিয়ে জাতীয় সংসদে গতকাল সংসদ অধিবেশন শুরু হয় বেলা ১১টায়। অধিবেশন কক্ষে সংসদ সদস্যদের বসতে হয়েছে দূরত্ব রেখে, মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে।

আজ বাজেট পাস : আজ পাস হচ্ছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। সংসদে ৫৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে ডজনখানেক সংসদ সদস্যের ছাঁটাই প্রস্তাব নিষ্পত্তির পর ‘নির্দিষ্টকরণ বিল, ২০২১’ পাস হবে। এর মাধ্যমে শেষ হবে নতুন অর্থবছরের বাজেট পাস কার্যক্রম। বাজেট পাসের পর আজই রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দেবেন। আগামীকাল ১ জুলাই নতুন অর্থবছরে তা বাস্তবায়ন শুরু হবে।

এর আগে ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। পরে দুই দিন আলোচনা করে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট পাস হয়। এরপর সপ্তাহখানেক বিরতি দিয়ে টানা চার দিন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। পরে আরও ১০ দিন বিরতি দিয়ে ফের দুই দিন বাজেটের ওপর আলোচনা হয়। গতকাল প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, জাতীয় পার্টি-জেপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাজেট আলোচনা শেষ হয়। এরপর পাস হয় অর্থবিল। সব মিলিয়ে এক শর মতো সংসদ সদস্য এবার বাজেটের ওপর আলোচনা করেন বলে সংসদ সচিবালয়সূত্রে জানা গেছে। সম্পূরক বাজেটসহ বাজেটের ওপর ছয় দিনে ১৫ ঘণ্টার মতো আলোচনা হয়েছে। এর আগে গত বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বাজেট অধিবেশন হয়েছিল। গত বছর (২০২০ সালে) নয় দিনের বাজেট অধিবেশনে ১৮ জন সংসদ সদস্য পাঁচ ঘণ্টা ১৮ মিনিট আলোচনা করেছিলেন।

করোনায় পাল্টে গেছে সব হিসাব-নিকাশ- অর্থমন্ত্রী : মহামারী রূপ নেওয়া কভিড-১৯ এর প্রভাবে সারা বিশ্ব আজ একটি নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। ল-ভ- হয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারা। পাল্টে গেছে সব হিসাব-নিকাশ। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল-কেউই নিস্তার পায়নি। বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতি আজ বিয়োগান্তক। তবে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আমাদের অর্থনীতি কখনো বিয়োগান্তক অবস্থায় পড়েনি বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে গতকাল অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে অংশ নেন।  অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের অনন্য অর্জনসমূহ রূপকথার গল্পগাঁথাকেও হার মানায়। এ সময়কালে আমাদের মাথাপিছু আয় ৬৮৬ ডলার থেকে দাঁড়িয়েছে ২,২২৭ ডলারে। জিডিপির আকার ৯১.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে দাঁড়িয়েছে ৩৫৫ বিলিয়ন ডলারে। রপ্তানির পরিমাণ ১৪.১ বিলিয়ন হতে প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬.১ বিলিয়ন হতে ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই করছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক রেকর্ড। প্রবাসী আয় ৭.৯ বিলিয়ন ডলার হতে বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই করছে। আমরা চলতি বছরের মতো আগামী অর্থবছরেও আমাদের নীতি পরিপ্রেক্ষিত জি সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করেছি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সংকটকালে বাজেটে গতবছরের মতো এবারও অগ্রাধিকার পাচ্ছে দেশের প্রান্তিক তথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কাউকে পেছনে না রেখে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে আগামীর পথে দূর, বহুদূর, বহুদূর—-নিরন্তর। জাতির পিতার তুলিতে আঁকা স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে।

 

সর্বশেষ খবর