শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

বৃষ্টি আর লকডাউনে ঘরবন্দী মানুষ রাস্তাঘাট ফাঁকা, প্রশাসন কঠোর

ঢাকায় ৩২০ আটক ২১৯ গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, সাড়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বৃষ্টি আর লকডাউনে ঘরবন্দী মানুষ রাস্তাঘাট ফাঁকা, প্রশাসন কঠোর

গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবেশমুখ আশুগঞ্জ টোল প্লাজায় চেকপোস্টে গাড়ির চালককে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে জারি করা সর্বাত্মক লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে গতকাল রাস্তাঘাট ছিল একেবারেই ফাঁকা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারের সঙ্গে দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টি থাকায় লোকজন ঘর থেকে বের হয়নি। রাজধানীতে অনেকটাই ঘরবন্দী ছিল মানুষ। ফুটপাথে মানুষের চলাচল ছিল একেবারেই কম। কাঁচা বাজারেও ছিল না বাড়তি ভিড়। জিনিসপত্রের দামও ছিল নাগালের মধ্যেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেকপোস্টে কড়াকড়িও কিছুটা শিথিল ছিল আগের দিনের চেয়ে। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল গ্রেফতারের সংখ্যা একেবারে কম নয়। ‘অপ্রয়োজনে’ বাসা থেকে বের হওয়ায় গতকাল রাজধানীতে ৩২০ জনকে আটকের কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। নগর পুলিশের গণমাধ্যম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আটক ছাড়াও ভ্রাম্যমাণ আদালত ২০৮ জনকে জরিমানা করেছে। মোট ২১৯ গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার বিপরীতে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। অন্যদিকে সারা দেশে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতে ২১৩ জনকে ২ লাখ ১৫ হাজার ৫৪০ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে লকডাউনের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার ঢাকার রাস্তায় আটক করা হয় ৫৫০ জনকে। তারা ‘অপ্রয়োজনে’ ঘর থেকে বের হয়েছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য।

কঠোর লকডাউনে রাস্তায় যাত্রী না থাকলেও বৃষ্টিতে ভিজে রিকশা নিয়ে বের হতে দেখা যায় অনেক রিকশাওয়ালাকে। বৃষ্টিতে ভিজে তারা রাস্তায় বেরিয়েছেন পেটের দায়ে।

লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে বাড্ডা, শাহজাদপুর, মালিবাগ, মৌচাক, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, কাকরাইল, ফকিরাপুল ও বিজয়নগর ঘুরে দেখা গেছে, মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্ট আছে, ব্যারিকেড আছে। তবে যানবাহনে তল্লাশি আগের দিনের তুলনায় কম ছিল। সরকারি বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে সারা দেশেই সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় মাঠে রাখা হয়েছে ১০৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে। অফিস-আদালত, গণপরিবহন, শপিং মল বন্ধ; জরুরি সেবার গাড়ি ছাড়া সব যান্ত্রিক বাহন চলাচলেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। জনসাধারণকে অনুরোধ জানানো হয়েছে ঘরে থাকার। এই বিধিনিষেধের মধ্যে জরুরি কারণ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হলে কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রথম দিনের কড়াকড়ির কারণে দ্বিতীয় দিনে সড়কে যানবাহনের সংখ্যা ছিল আগের চেয়ে অনেক কম। এ ছাড়া দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার কারণেও লোকজন ঘরবন্দী ছিল। এরপরও বিভিন্ন এলাকার বাজার ও অলিগলিতে মানুষের জটলা এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। অনেক এলাকায় পুলিশের টহল দেখে মানুষ দৌড়ে ঘরে ঢোকা এবং পুলিশ চলে গেলে আবারও ঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখা গেছে। শুক্রবার থাকায় অনেককেই কাঁচা বাজার করতে দেখা যায়। কাঁচা বাজারে কিছুটা উপেক্ষিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি।

র‌্যাবের পরিচালক (মিডিয়া) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, চেকপোস্ট ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি র‌্যাবের পক্ষ থেকে বিনা প্রয়োজনে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য জনসচেতনতামূলক মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও বিনামূল্যে মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১০০ দুস্থ পরিবারকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তাও  দেওয়া হয়েছে। র‌্যাব সদর দফতর জানিয়েছে, লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে সারা দেশে র‌্যাবের ১৬৬টি টহল এবং ১৪৫টি চেকপোস্ট পরিচালনা করা হয়। এ ছাড়া সারা দেশে র‌্যাব ৫৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। এসব ভ্রাম্যমাণ আদালতে ২১৩ জনকে ২ লাখ ১৫ হাজার ৫৪০ টাকা জরিমানা করা হয়।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চট্টগ্রাম : সর্বাত্মক লকডাউনের দ্বিতীয় দিনেও গতকাল চট্টগ্রামের প্রশাসন কঠোর অবস্থানে ছিল। সড়কে ছিল না কোনো মানুষ, যানবাহন। সড়কে যান বলতে দেখা যায় কেবল রিকশা। বাসা থেকে বের হলেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তাই অনেকেই বের হচ্ছে না বাসা থেকে। গতকাল সকাল থেকে দুপুর ও বিকালে এমন চিত্র দেখা যায়। তাছাড়া নগরের চার প্রবেশপথে তল্লাশিও অব্যাহত রয়েছে। জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় সেনাবাহিনীর ৬টি টিম কাজ করছে। এ ছাড়াও বিজিবির ৬টি টিম নগরজুড়ে টহল দিচ্ছে। সকাল থেকেই দুই শিফটে ভাগ হয়ে মাঠে আছেন জেলা প্রশাসনের ১২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং উপজেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনাররা (ভূমি)। তাছাড়া মাঠে আছে পুলিশ। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা এবং মানুষকে সতর্ক, সচেতন বুঝিয়ে বাসায় ফেরত দিচ্ছেন। 

সরেজমিন দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হয় কঠোর লকডাউন। তবে গতকাল অফিসে যাওয়ার তাড়া না থাকায় চিরায়ত কর্মব্যস্ততা দেখা যায়নি। সকাল থেকেই অনেকটা ফাঁকা নগরের সড়ক, গলি উপ-গলি। কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন দেখা যায়নি।

সিলেট : সিলেটে ছিল প্রশাসনের কড়াকড়ি। রাস্তায় ছিল পুলিশের চেকপোস্ট ও তল্লাশি। নগর ও নগরের বাইরে ছিল ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি ও লকডাউন ভঙ্গের দায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে প্রশাসন। সকাল থেকে নগরের প্রবেশদ্বার চন্ডিপুল, হুমায়ূন রশিদ চত্বর, টিলাগড়, কুমারগাঁও ও বিমানবন্দর এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন আটকানো শুরু করে পুলিশ। নগরীর গুরুত্বপূর্ন সকল পয়েন্টেই ছিল পুলিশের নজরদারি। রিকশা, গাড়ি ও মোটর সাইকেল আটকে লকডাউনের মধ্যে বাসা থেকে বের হওয়ার কারণ জানতে চেয়েছে পুলিশ। বিকাল ৫টার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা রাখায় কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিকাল ৫টার দিকে নগরের হুমায়ূন রশিদ চত্ত্বরে বর ও কনেবাহী একটি মাইক্রোবাস আটকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। লকডাউনের মধ্যে নগরের মোমিনখলা এলাকা থেকে কনে আনতে গিয়েছিলেন বর। 

রংপুর : বৃষ্টিতে ভিজেও রংপুরে লকডাউন বাস্তবায়নে কাজ করেন স্থানীয় প্রশাসন। কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কাঁচা বাজার নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানপাট খোলা থাকায় সেখানে ক্রেতাদের কিছুটা ভিড় দেখা গেছে। সেখানে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কেনাকাটা করায় দুপুরের দিকে সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। নগরের চেকপোস্টের মাধ্যমে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া মানুষদের ফেরত পাঠানো হয়।

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহেও কঠোর অবস্থানে ছিল স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নগরের প্রত্যেকটি প্রবেশমুখ ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কাজ করতে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হয়ে সঠিক কারণ দেখাতে না পারায় বেশ কয়েকজনকে আর্থিক জরিমানা গুনতে হয়। ওষুধ ও নিত্যপণ্য ছাড়া প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ ছিল। বিধিনিষেধ না মানায় জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৫২৫টি মামলায় প্রায় ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলায় ৩৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ১০টি টিম, বিজিবির ৮টি টিম ছাড়াও পুলিশের ১৮টি মোবাইল টিম মাঠে কাজ করছে।

বরিশাল : জরুরি পণ্য ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ ছিল বরিশালে। গতকাল রাস্তায় মানুষ চলাচল কিছুটা বাড়লেও পরিস্থিতি সন্তোষজনক বলে দাবি স্থানীয় প্রশাসনের। এদিকে নিত্যপণ্যের বাজারে অতিরিক্ত মূল্য রাখা এবং মাস্ক না পরা ও অযথা ঘরের বাইরে বের হওয়ায় কয়েকজনকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

রাজশাহী : লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে রাস্তাঘাটে মানুষ বের হলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়েছে। সকাল থেকে দৈনন্দিন কাজে মানুষ বের হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চলাচলও কমেছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকাসহ ৯টি উপজেলায় তিন প্লাটুন বিজিবি ও তিন প্লাটুন সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। রাজশাহীতে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ৫০টি মামলায় ৬৬ হাজার ৭৫০ টাকা জরিমানা করেছে। সেই সঙ্গে ৮৬০টি মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে ৮৬ মামলায় জরিমানা ৫২ হাজার টাকা, মাদারীপুরে ৫০ মামলায় ২৮ হাজার টাকা জরিমানা, নাটোরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ১৫ ব্যক্তিকে জরিমানা, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৪০ জনকে জরিমানা করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৫৪ জনকে ৮৮ হাজার টাকা জরিমানা, পটুয়াখালীর গলাচিপায় ১৫ জনকে জরিমানা, বাগেরহাটে ৭৩টি মামলায় ৭৬ জনকে ৪৩ হাজার ৩৫০ টাকা জরিমানা করেছে। গোপালগঞ্জের বড় বাজারে সুন্দরবন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে বসিয়ে লোক খাওয়ানোর অপরাধে মালিককে ৩ হাজার টাকা জরিমানা, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১৩ জনকে অর্থদন্ড, চাঁদপুরে ৯ মামলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত সাড়ে ১৩ হাজার টাকার জরিমানা, বগুড়ায় তিন মামলায় ২ হাজার টাকা জরিমানা, টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ১৩ পথচারীকে ৩৪০০ টাকা জরিমানা এবং সিলেটের বিশ্বনাথে ৯ মামলায় ৬ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সর্বশেষ খবর