শুক্রবার, ৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতেই আওয়ামী লীগ

সাংগঠনিক ৪২ জেলার মেয়াদ শেষ, অর্ধেকের বেশি থানা উপজেলায় একই হাল করোনার কারণে সম্মেলন ও কমিটি গঠনে বিলম্বের কথা বলেন নেতারা

রফিকুল ইসলাম রনি

মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতেই আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের ৭৮ সাংগঠনিক জেলা কমিটির ৪২টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় এসব জেলায় নতুন নেতৃত্ব আসছে না। ফলে হতাশ পদপ্রত্যাশীরা। পাশাপাশি ঝিমিয়ে পড়ছে সাংগঠনিক কর্মকান্ড।

শুধু জেলা নয়, ৬৫০টি সাংগঠনিক উপজেলা-থানা কমিটির দুই তৃতীয়াংশের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। কোথাও কোথাও এক থেকে দেড় যুগ সম্মেলন নেই। কত হাজার ইউনিয়ন-ওয়ার্ড কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ সে পরিসংখ্যান নেই দলের কাছে। সর্বত্র বেহাল অবস্থা। জেলা-উপজেলা মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে চলছে আওয়ামী লীগ। ফলে দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় ‘ক্ষমতা’ কুক্ষিগত করার সুযোগ পাচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। এ কারণে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল বেড়েই চলেছে।

কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, করোনার কারণে সম্মেলন ও কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে। দলীয় সূত্রমতে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলন সামনে রেখে তৃণমূল ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শুরু হয়েছিল উপজেলা-জেলা সম্মেলন। তবে হাঁকডাক দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলার সম্মেলন শুরু হলেও নানা জটিলতায় তা আর করা যায়নি। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে মাত্র ২৯টি জেলা সম্মেলন করতে সক্ষম হন নেতারা। জাতীয় সম্মেলনের পর ২০২০ সালে জানুয়ারিতে পুনরায় জেলা-উপজেলা সম্মেলনের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগের বগুড়া, জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সম্মেলন করতে সক্ষম হন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। গত বছর মার্চে করোনা মহামারী শুরু হলে ভাটা পড়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নেতা-কর্মীদের পুনরায় সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করতে নির্দেশ দেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংগঠনিক গতি বাড়াতে জেলা-উপজেলা নেতাদের কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠান। করোনা মহামারী কিছুটা কমে এলে ফেব্রুয়ারিতে উপজেলা সম্মেলন শুরু হয়। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগের ২৭ উপজেলার সম্মেলন শেষ করা হয়। ঢাকা বিভাগের কয়েকটি উপজেলারও সম্মেলন হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ জেলাগুলোর সম্মেলন শেষ করার লক্ষ্য স্থির করেছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জেলা-উপজেলা সম্মেলন যথাসময়ে শেষ করার সব ধরনের প্রস্তুতি ছিল। নেত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারী আবারও বাড়ায় কাজের গতি কিছুটা কমে এসেছে। সবার আগে মানুষের জীবন এ চিন্তা রেখে আপাতত ভার্চুয়ালি কর্মসূচি, করোনায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি। করোনার প্রকোপ কমলেই সাংগঠনিক কাজ জোরদার করব।’

ঢাকা বিভাগে সাংগঠনিক জেলা ১৭টি। ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বড় শক্তি মনে করা হয়। মহানগরীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হলেও থানা-ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটির বেহাল অবস্থা। এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ওয়ার্ড-ইউনিট কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিলেও মহানগরী নেতারা সেদিকে দৃষ্টি দেননি। তারা ‘মাইম্যান’ বসাতে আগে থানা কমিটি করতে আগ্রহী। যে কারণে স্থবিরতা বিরাজ করছে ওয়ার্ড-ইউনিটগুলোয়। এ বিভাগে চারটি মহানগরী রয়েছে- ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর মহানগরী। বাকি ১৩ জেলা হলো- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও টাঙ্গাইল। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরী উত্তর, দক্ষিণ ছাড়া বাকি ১৫ সাংগঠনিক জেলাই মেয়াদোত্তীর্ণ। ঢাকা বিভাগে শতাধিক উপজেলা ও সাংগঠনিক থানা রয়েছে ২ শতাধিক। এর বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলার সম্মেলন ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে একটি গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে রাজবাড়ী জেলাসহ অনেক উপজেলা সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত আছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই পুরোদমে জেলা সম্মেলন শুরু করব।’

চট্টগ্রাম বিভাগে আওয়ামী লীগের ১৫ সাংগঠনিক জেলা। এর মধ্যে ১৩ জেলা ও দুই মহানগরী। এগুলো হলো- কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম মহানগরী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা উত্তর, দক্ষিণ, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান। এর মধ্যে আটটির সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। এ বিভাগে ১২৯ উপজেলা সমমর্যাদার শাখা কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে সম্মেলন হয়েছে ৫৯টির।

চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের দায়িত্বে এসেছি। যেসব জেলা-উপজেলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে আপাতত সেগুলো মেটানোর কাজ করছি। ইতিমধ্যে বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা হয়েছে। পরিস্থিতি অনুকূলে এলেই সম্মেলন শুরু করবে।’

রাজশাহী বিভাগে আওয়ামী লীগের আট জেলা ও এক মহানগরী। ২১তম জাতীয় সম্মেলনের পর বগুড়া, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী মহানগরীর সম্মেলন হয়েছে। এ ছাড়া বিভাগের ২৭ উপজেলা সম্মেলন করে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। চার জেলা এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ। এ বিভাগে ৮৩ উপজেলার সমমর্যাদার কমিটি রয়েছে। ৫৬ উপজেলার সম্মেলনের কাজ চলছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘১৫-২০টি উপজেলার সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে আমরা সেগুলো করতে পারিনি। আশা করছি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে সব থানা, উপজেলা এবং ডিসেম্বরের মধ্যে সব জেলা সম্মেলন ও কমিটি গঠনের কাজ শেষ করা যাবে।’

রংপুর বিভাগে আওয়ামী লীগের আট জেলা ও এক মহানগরী। মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়।

ময়মনসিংহ বিভাগে আওয়ামী লীগের চার জেলা ও এক মহানগরী। সেগুলো হলো- ময়মনসিংহ মহানগরী, ময়মনসিংহ জেলা, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোনা। এর সবই বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ। একই অবস্থা বিভাগের উপজেলা, থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোরও।

খুলনা বিভাগে আওয়ামী লীগের ১১ সাংগঠনিক জেলা। মেয়াদোত্তীর্ণ চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। অনেক উপজেলারও সম্মেলন বাকি।

বরিশাল বিভাগে আওয়ামী লীগের সাত সাংগঠনিক জেলা। সেগুলো হলো- বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল মহানগরী, বরিশাল জেলা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও বরিশাল মহানগরীর সম্মেলন হয়েছে। এ তিন সাংগঠনিক জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটিও ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি চার জেলা এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ।

সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগের পাঁচ সাংগঠনিক জেলা। সেগুলো হলো- সুনামগঞ্জ, সিলেট জেলা, সিলেট মহানগরী, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। আওয়ামী লীগের সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘গত জাতীয় সম্মেলনের আগে সুনামগঞ্জ ছাড়া এ বিভাগের অন্য জেলাগুলোর সম্মেলন হয়েছে। এগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়েছে। এ পাঁচ জেলার মধ্যে সিলেট জেলা, মহানগরী, মৌলভীবাজারের উপজেলাগুলোর সম্মেলন হয়েছে। তবে হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার সম্মেলন বাকি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সেগুলোর সম্মেলন ও কমিটি গঠনের কাজ শুরু করব।’

সর্বশেষ খবর