শুক্রবার, ৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা
বিশ্ব নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

তহবিল বাড়াতে হবে জলবায়ু করোনার প্রভাব মোকাবিলায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

তহবিল বাড়াতে হবে জলবায়ু করোনার প্রভাব মোকাবিলায়

জলবায়ু পরিবর্তন এবং চলমান করোনা মহামারীর প্রভাব মোকাবিলায় আরও তহবিল সরবরাহ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সন্ধ্যায় গণভবন থেকে ‘প্রথম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অর্থ সম্মেলন (ভার্চুয়াল)’-এর উদ্বোধনকালে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ প্রথম অর্থমন্ত্রীদের জন্য এ সম্মেলনের আয়োজন করে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং কভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় প্রযুক্তি স্থানান্তর ও অতিরিক্ত তহবিলের ব্যবস্থা করা উচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও উন্নত দেশগুলোকে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং নৈতিক ও আইনি বাধ্যবাধকতা পালন করা উচিত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিভিএফ-ভি টোয়েন্টি গ্রুপের ৪৮ সদস্য-রাষ্ট্রের মাধ্যমে নির্গত বৈশ্বিক নিঃসরণের মাত্র ৫ শতাংশ, কিন্তু তারাই এ মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। করোনা মহামারী পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে চলমান কভিড-১৯ মহামারী নতুন করে মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট যোগ করেছে। চলমান ও ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় আমাদের অবশ্যই ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং সহযোগিতা বাড়াতে হবে।’

সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব রাখেন। প্রথম প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে রাখতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন রোধে প্রতিটি দেশকে উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য অনুসরণ করতে হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর উচিত সিভিএফ-ভি ২০ দেশের সবুজ পুনরুদ্ধারের সুবিধার্থে এবং মূলধনের ব্যয় হ্রাস ও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য নিবেদিত সমর্থন করা। তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তহবিলের প্রবাহ অবশ্যই অনুমানযোগ্য, ভারসাম্যপূর্ণ, উদ্ভাবনী ও বর্ধনশীল হতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাবে তিনি জলবায়ুর ক্ষতির মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর আহ্বান জানান। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সক্রিয়ভাবে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’-এর মতো ‘ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ গ্রহণ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান প্রস্তুত করছে বাংলাদেশ এবং ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এ বছর দেশব্যাপী প্রায় ৩০ মিলিয়ন চারাগাছ রোপণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর সরকার একটি নিরাপদ, সুরক্ষিত, জলবায়ু পরিবর্তন-সহনশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ প্রস্তুত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের আওতাধীন নতুন সিভিএফের এবং ভি টোয়েন্টি জয়েন্ট মাল্টি-ডোনার ফান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দাতা দেশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ একটি ‘প্ল্যানেটারি ইমারজেন্সি’ ঘোষণা করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিশ্বের অন্য নেতাদের কাছ থেকেও এ ধরনের পদক্ষেপ আশা করছি।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ ‘খুরুশকুল স্পেশাল শেল্টার প্রজেক্ট’ নামে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জালবায়ু শরণার্থী পুনর্বাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে ১৩৯টি সুউচ্চ ভবনে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হবে। শেখ হাসিনা বলেন, সিভিএফ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হয়ে একটি টেকসই জলবায়ু-সহনশীল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং এরপর জলবায়ু পরিবর্তন-সহনশীল ব্যবস্থা থেকে জলবায়ু সমৃদ্ধির দিতে এগোতে একটি নতুন জলবায়ুসমৃদ্ধ কার্যক্রম শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর সম্মানে “মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান-ডিকেড ২০৩০” ঘোষণা করতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।’

প্রধানমন্ত্রী কার্বন নিঃসরণ কমাতে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ও কার্যক্রমের ব্যাপারে অবশ্যই সুবিবেচক হতে হবে এবং একটি টেকসই জলবায়ু-সহনশীল বিশ্ব গড়ে তুলতে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।’ জলবায়ু সমৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক সমাধান বের করতে সব অর্থমন্ত্রী, উন্নয়ন অংশীদার, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। জলবায়ু-ঝুঁকির সূচক ২০২০-এর মতে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। কভিড-১৯ মহামারী ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও ২০২০ সালে আঘাত হানা সুপার সাইক্লোন আম্ফানের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষ জীবিকা হারিয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এবং স্থানীয়-নেতৃত্বাধীন অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্বের অন্যতম আসনে রয়েছে। বাংলাদেশে গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয় অবস্থিত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতি বছর আমরা আমাদের জিডিপির প্রায় ২.৫ শতাংশ বা প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় টেকসই জলবায়ু-সহনশীল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যয় করি।’

তিনি বলেন, চলমান বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যে তাঁর সরকার ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ২৩টি পুনরুদ্ধার প্যাকেজ চালু করেছে। এটা জিডিপির আনুমানিক ৪.২ শতাংশ। সিভিএফ দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভান ডুক মারকিজ, ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট সাহলে-ওয়ার্ক জেভেডে, কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট কার্লোস আলভারাদো কাসাদা, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ক্রিস্টোফার লোয়াক, জলবায়ু-সংক্রান্ত প্রেসিডেনশিয়াল দূত জন কেরি, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের গ্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রেসিডেন্ট মাসাতাসুগু আসাকাওয়া এবং ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের সভাপতি ভারনার হোয়রেরে প্রমুখ বক্তব্য দেন। গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের চেয়ার বান কি-মুন, ভি টোয়েন্টি দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী, জি৭ভুক্ত ও জি২০ভুক্ত দেশগুলোর মন্ত্রী ও প্রতিনিধি, আইএফআইএস ও এমডিবিএর প্রধান এবং অংশীদাররা এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

সর্বশেষ খবর