সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ভারতে দাম বাড়ায় জ্বালানি তেল পাচারের আশঙ্কা

লোকসানের বোঝা নামছেই না পেট্রোলিয়াম করপোরেশন থেকে, দুই দেশের মধ্যে ডিজেলের দামে পার্থক্য লিটারে ৫৩ টাকা

শামীম আহমেদ

আন্তর্জাতিক বাজারে দর বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের খুচরা বাজারে বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম। গত ৬৮ দিনে অন্তত ৩৮ বার তেলের দাম বেড়েছে দেশটিতে। শুধু পেট্রোলই নয়, ডিজেলের দামও দেশটির কোনো কোনো রাজ্যে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জ্বালানি তেলের দামের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে প্রতি লিটারে ২৮ টাকা থেকে ৫৩ টাকা পর্যন্ত। দামের এই বিস্তর ফারাকের কারণে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এরই মধ্যে আমাদের সীমান্ত জেলাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন শত শত ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশে পণ্য নিয়ে আসছে। আসার সময় যৎসামান্য তেল নিয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকলেও ফিরছে ট্যাংক পূর্ণ করে। এ ছাড়া অরক্ষিত সীমান্ত ও সমুদ্রপথেও তেল পাচারের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দেশটির পাঁচটি মেট্রো শহর দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা ও বেঙ্গালুরুতে জ্বালানি তেলের দাম সেঞ্চুরি পেরিয়েছে দুই দিন আগেই। গতকাল মুম্বাইতে ১ লিটার পেট্রোল ১০৬. ৯৩ রুপিতে ও ডিজেল ৯৭.৪৬ রুপিতে বিক্রি হয়েছে। দেশটির রাজস্থানের গঙ্গানগরে প্রতি লিটার পেট্রোল ১১২.২৪ রুপিতে ও ডিজেল ১০৩.১৫ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। দিল্লিতে প্রতি লিটার পেট্রোল ১০০.৯১ রুপি ও ডিজেল ৮৯.৮৮ রুপি, চেন্নাইয়ে পেট্রোল ১০১.৬৭ রুপি ও ডিজেল ৯৪.৩৯ রুপি, কলকাতায় পেট্রোল ১০১.০১ রুপি ও ডিজেল ৯২.৯৭ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় ভারতে প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম এখন ১১৪ থেকে ১২৭.৯৫ টাকা পর্যন্ত এবং প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১০২ টাকা থেকে ১১৭.৫৯ টাকা পর্যন্ত। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে ২০১৬ সাল থেকে প্রতি লিটার ডিজেল ৬৫ টাকায় ও প্রতি লিটার পেট্রোল ৮৬ টাকায় ও প্রতি লিটার অকটেন ৮৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশের অকটেনের দামের চেয়ে ভারতে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম অন্তত ১৩ টাকা বেশি। দুই দেশের মধ্যে পেট্রোলের দামের পার্থক্য লিটারে সর্বোচ্চ ৪২ টাকা ও ডিজেলের দামের পার্থক্য লিটারে সর্বোচ্চ ৫২.৫৯ টাকা। এ অবস্থায় চোরাইপথে বাংলাদেশ থেকে জ্বালানি তেল, বিশেষ করে ডিজেল পাচারের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভারতে এখন জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশের দামের প্রায় দ্বিগুণ। এমন পরিস্থিতিতে চোরাচালান বাড়াটাই স্বাভাবিক। ভৌগোলিকভাবে পাশাপাশি দেশে একই ধরনের পণ্যের দামে অবশ্যই ভারসাম্য থাকতে হবে। আমাদের এখানে সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেয়, ভারত উল্টো ট্যাক্স আরোপ করে। কেন্দ্রীয় সরকার এক ধরনের ট্যাক্স বসায়, আঞ্চলিক সরকারগুলো আবার তাদের মতো করে ট্যাক্স বসায়। তাই রাজ্যভেদে দামও ভিন্ন ভিন্ন। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে স্থানীয় পর্যায়েও দাম বাড়ায়, আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে স্থানীয় পর্যায়ে কমায়। সারা বিশ্ব এভাবেই চলে। এটা হলে পাচারের ঝুঁকি থাকে না। শুধু বাংলাদেশই উল্টো চলে। এখানে এক দামেই চলছে পাঁচ বছর। এ ছাড়া বছরের পর বছর জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার। এভাবে ভর্তুকি কত দিন দিয়ে যাবে? এখানে ভর্তুকির কিছু নেই। যখন যেমন দাম, তখন তেমন দামে বিক্রি করাটাই নিয়ম। যদি কোনো খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার হয়, সেই খাতকে আলাদাভাবে ভর্তুকি দেওয়া যায়। এর আগে ২০১৮ সালের মে মাসে ভারতে জ্বালানি তেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালে বাংলাদেশ থেকে পাচার বেড়ে যায়। পাচারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের ঘটনাও ঘটে। তখন বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতের আসাম বা পশ্চিমবঙ্গে ডিজেলের বিক্রয়মূল্য ছিল প্রতি লিটার ৭১ রুপি, যা ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৮ টাকার সমান। আর বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্য ছিল প্রতি লিটার ৬৫ টাকা। দুই দেশের মধ্যে প্রতি লিটার ডিজেলের দামের পার্থক্য দাঁড়ায় ২৩ টাকা। তিন বছর পর এখন দুই দেশের মধ্যে ডিজেলের দামের পার্থক্য দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। গত মে মাসে ১৬ দফায় ও জুন মাসে আবার ১৬ দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে ভারতে। চলতি মাসেও কয়েক দফা বেড়েছে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি লিটার পেট্রোলের দামের পার্থক্য এখন ২৮ থেকে ৪১.৯৫ টাকা ও ডিজেলের দামের পার্থক্য ৩৭.৪৬ টাকা থেকে ৫২.৫৯ টাকা পর্যন্ত। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী স্থানীয় বাজার থেকে মাত্র ২০ লিটার ডিজেল কিনে সীমান্তের ওপারে পৌঁছাতে পারলেই ৭৪০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা ভর্তুকির তেল দেশের বাইরে পাচারের আশঙ্কা বাড়িয়েছে। বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের সময়ে প্রতি ব্যারেল ক্রুড অয়েলের আন্তর্জাতিক দর ছিল ২৭ ডলার। তখন প্রতি লিটার ডিজেলের বিক্রয়মূল্য ৬৫ টাকা, পেট্রোল ৮৬ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এরপর একাধিকবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ওঠানামা করলে বাংলাদেশে খুচরা বাজারে মূল্য সমন্বয় করা হয়নি। গত বছর কভিড পরিস্থিতি শুরু হলে আবারও বাড়তে থাকে তেলের আন্তর্জাতিক দর। গত ২৫ জানুয়ারি প্রতি ব্যারেল লন্ডন ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম বেড়ে হয় ৫৫.৭৫ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ওটিআই ক্রুড অয়েলের দাম বেড়ে হয় ৫২.৬৪ ডলার। গত ৯ জুলাই এই দুই ধরনের ক্রুড অয়েলের দাম বেড়ে হয় যথাক্রমে ৭৫.৫৫ ডলার ও ৭৪.৫৬ ডলার। এর আগে ৫ জুলাই আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক অপরিশোধিত তেলের দাম ১ শতাংশ বেড়ে ব্যারেল প্রতি ৭৭ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে অপরিশোধিত তেলের দাম। ফলে টানা ১৩ বছরের বেশি লোকসান করে আসা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে লাভের মুখ দেখা শুরু করলেও আবারও বাড়ছে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের বোঝা। সেই সঙ্গে ভর্তুকি দেওয়া মূল্যবান জ্বালানি পাচার হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিপিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দামের পার্থক্য বেশি হলে চোরাচালান বাড়া স্বাভাবিক। এ জন্য আমরা বিজিবিকে আগেই চিঠি দিয়ে রেখেছি। প্রয়োজনে আবার দেব। আগে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমাদের এখানে কমেনি। তখন লাভ করেছি। এখন ভর্তুকি দিচ্ছি। ভর্তুকি দিতে দিতে অপারগ হয়ে গেলে তখন সরকারকে জানাব। তেলের দাম সমন্বয় করে সরকার, বিপিসি নয়।

বিপিসি সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় দরের মধ্যে পার্থক্য থাকায় বছরের পর বছর লোকসানে পরিচালিত বিপিসি গত ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে লাভের মুখ দেখে। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা লোকসান করে বিপিসি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে লাভের মুখ দেখলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা দেওয়ায় ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে আবারও লোকসানে পড়ে বিপিসি। বছর পার করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এসে সংস্থাটি আবার লাভের মুখ দেখলেও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আবারও ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এ অবস্থা চলতে থাকলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মতো বিপিসিও এক দিন ঋণের ভারে ডুবে হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

সর্বশেষ খবর