বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা
মেডিকেল ইকুইপমেন্ট রপ্তানি ৩৬ দেশে

প্যাকেজিংয়ের ভুলে জেল খাটলেন জেএমআই এমডি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্যাকেজিং কর্মীদের ভুলে কম দামি ফেস মাস্কের পরিবর্তে সরবরাহ করা হয় গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য রাখা বেশি দামি এন-৯৫ মাস্ক। নজরে আসার পর ফেরতও নেওয়া হয় ভুলে পাঠানো মাস্কগুলো। কিন্তু এ ভুলেই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে এশিয়ার অন্যতম কেএন-৯৫ মাস্ক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবদুর রাজ্জাককে। কারাগার ও রিমান্ডেও যেতে হয়েছে তাকে।

জানা গেছে, গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হন। ওই সময় চিকিৎসকসহ হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টদের করোনা সংক্রমণ রুখতে ক্রয় প্রক্রিয়া গ্রহণের আগেই জরুরি ভিত্তিতে ৫০ লাখ পিস ফেস মাস্ক সরবরাহ করতে জেএমআই গ্রুপকে অনুরোধ জানায় সরকার। গত বছর ২৩ মার্চ দেওয়া এক চিঠিতে সরকার এ অনুরোধ জানায়। ওই চিঠিতে মাস্কের কোনো স্পেসিফিকেশন ও ব্র্যান্ড উল্লেখ না থাকলেও মহামারী বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত ফেস মাস্ক সরবরাহের প্রস্তুতি নেয় জেএমআই গ্রুপ। আরও জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে চলাচলে বিধিনিষেধ জারি থাকলেও শুধু সরকারের অনুরোধে জরুরি ভিত্তিতে ৮ লাখ ৩ হাজার ৬১০ পিস ফেস মাস্ক সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। তড়িঘড়ি সরবরাহ করতে গিয়ে সাধারণ ফেস মাস্কের পরিবর্তে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য রাখা ২০ হাজার ৬১০ পিস এন-৯৫ মাস্ক পাঠানো হয়। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে কারও ব্যবহারের আগেই ওসব মাস্ক ফেরত আনা হয়।

কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের ভান্ডার ও রক্ষণের তখনকার পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ নিয়ে জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে চিঠির জবাবে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, মাস্ক তৈরি ‘ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে’ আছে। ভুলক্রমে সেগুলো সরবরাহ করা হয়েছে। চিঠিতে এমডি আবদুর রাজ্জাক দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় সরবরাহ করা মাস্ক ফেরত নিয়ে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুলের’ দায় থেকে মুক্তি চান। ওই সময় বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জেএমআই নিজেও মাস্ক সরবরাহে ভুলের বিষয়টি জানায়। জানতে চাইলে জেএমআই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাপান থেকে দেশে ফিরে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। বিশ্বের ৩৬টি দেশে আমরা চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম রপ্তানি করছি। এমনকি করোনার টিকা প্রদানের জন্য সবচেয়ে জরুরি বস্তু সিরিঞ্জ আমরাই সরকারকে সরবরাহ করে আসছি। এখন পর্যন্ত ১১ কোটি সিরিঞ্জ সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানির প্যাকেজিং কর্মীদের একটি ভুলের কারণে আমাকে জেলে যেতে হয়েছে। রিমান্ডে যেতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘হয়রানির উদ্দেশ্যেই এ মামলা। মামলায় আমি ৭ নম্বর আসামি। ৬ নম্বর পর্যন্ত আসামি কারও বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। অথচ নিম্ন আদালত আমাকে জামিন দিলে সে জামিন বাতিলের চেষ্টা হয়েছে। হাই কোর্ট জামিন বহাল রাখার পরও জামিন বাতিলের চেষ্টা করা হয়েছে।’ মাস্ক সরবরাহের বিষয়ে জেএমআইর পক্ষ থেকে বলা হয়, গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ৫৬টি চালানের মাধ্যমে ৮ লাখ ৩ হাজার ৬১০ পিস মাস্ক সরবরাহ করে। কিন্তু কারখানা লোডারদের অসতর্কতার কারণে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য রাখা জেএইচআরএমএলের ২০ হাজার ৬১০ পিস মাস্ক জেএমআই ফেস মাস্ক এন-৯৫ লেখা বক্সে সরবরাহ করা হয়। তারা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকার পরও জেএমআইর আগ বাড়িয়ে এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের কোনো কারণই নেই। এটি একটি অসতর্কতামূলক ঘটনা, কোনোভাবেই অসদুদ্দেশ্যে নয়।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, চীনে প্রথম করোনা সংক্রমণ শুরু হলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে চিকিৎসা ও সুরক্ষা সামগ্রী পাঠনো হয়। ওই উপহারসামগ্রী সরবরাহেও যুক্ত করা হয়েছিল জেএমআইকে। তারা আরও বলেন, এ মহামারীর সময় জেএমআই গ্রুপ অর্থনৈতিক লাভের জন্য নয়, দেশ ও জাতির স্বার্থে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। চীনকে পাঠানো উপহার থেকে করোনা সংক্রমণের সঙ্গে যুক্ত কোনো সরবরাহের মূল্য এখনো পরিশোধ করা হয়নি। ফলে এখান থেকে বিন্দুমাত্র লাভবান হয়নি বলেই মনে করে প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ দেশে করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু হলে এ টিকা দেওয়ার জন্য ১১ কোটি সিরিঞ্জ সরবরাহ করেছে জেএমআই।

এ ঘটনার সময় কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০ হাজার নকল এন-৯৫ মাস্ক আসল দেখিয়ে ১০টি হাসপাতালে সরবরাহের অভিযোগে জেএমআই এমডি আবদুর রাজ্জাক, সিএমএসডির সাবেক উপপরিচালক ও কক্সবাজার মেডিকেলের তত্ত্বাবধায়ক জাকির হোসেন খানসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদকের মামলার অভিযোগে বলা হয়, দুটি চালানের মাধ্যমে মেসার্স জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড তখন সিএমএসডিতে ২০ হাজার ৬০০ মাস্ক সরবরাহ করেছিল। চালানে মাস্কগুলোকে এন-৯৫ ফেস মাস্ক (অ্যাডাল্ট) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিদর্শনে উঠে আসে যে মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে বাস্তবে তা এন-৯৫ মাস্ক নয়। এ মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জেএমআই এমডিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। পরে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত জেল হাজতেও থাকতে হয়েছে তাকে। ১৫ অক্টোবর এ মামলায় অধস্তন আদালত থেকে জামিন পান তিনি। এ জামিন বাতিলে দুদক হাই কোর্টে গেলেও কাজ হয়নি। জানা গেছে, হাই কোর্ট জামিন কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। ওই রুলের শুনানি শেষে গত ১৯ জানুয়ারি দেওয়া রায়ে দুদকের আবেদন খারিজ করে দেয় হাই কোর্ট। সর্বশেষ ১৬ মার্চ আদালতের নির্দেশে বিদেশ সফরেরও অনুমতি পান জেএমআই এমডি আবদুর রাজ্জাক।

সিরিঞ্জ ও মাস্ক রপ্তানিতে সম্ভাবনা : জানা গেছে, জেএমআই উৎপাদিত এডি (অটো ডিসেবল) সারা বিশ্বেই স্বনামধন্য। সম্প্রতি দেশের চাহিদা মিটিয়ে জেএমআই গ্রুপ উৎপাদিত এ সিরিঞ্জ ব্যাপকভাবে বিদেশে রপ্তানি করছে। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় ১ কোটি ৫০ লাখ পিস এডি সিরিঞ্জ রপ্তানি করেছে। করোনা ভ্যাকসিন মানবশরীরে প্রয়োগে বিশ্বব্যাপী এডি সিরিঞ্জের চাহিদা বেড়েই চলেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ এ সিরিঞ্জ পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ রপ্তানি সফলভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও এ দেশের ভাবমূর্তি ও সুনাম ব্যাপকভাবে বাড়াবে বলে মনে করে জেএমআই।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, এরই মধ্যে সরকার জেএমআই উদ্ভাবিত কেএন-৯৫ মাস্ক বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও জেএমআই উৎপাদিত কেএন-৯৫ মাস্কের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই কেএন-৯৫ মাস্ক বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হলে করোনা-পরবর্তী এ দেশের অর্থনীতি অনেকটা চাঙা হয়ে উঠবে।

সর্বশেষ খবর