রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

বাড়ি ফেরাতে নেই স্বাস্থ্যবিধি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাড়ি ফেরাতে নেই স্বাস্থ্যবিধি

সদরঘাটে গতকাল ঘরমুখী মানুষের ঢল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

লকডাউন শিথিলের তৃতীয় দিনে গতকাল বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে ঈদুল আজহা সামনে রেখে ঘরমুখী মানুষের ভিড় তুলনামূলক কম দেখা গেছে। বাস ও লঞ্চ মালিকরা বলছেন, কিছু আসন ও কেবিন খালি রেখে বাস-লঞ্চ ছাড়তে হয়েছে। আন্তনগর ট্রেনে ভিড় কিছুটা কম থাকলেও লোকাল ও কমিউটারে ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। যাত্রীদের মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য প্রশাসন নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে অধিকাংশ স্থানেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকার বাইরে মাওয়া-শিমুলিয়া ও বাংলাবাজার ফেরিঘাট যাত্রীর চাপে ছিল ঠাসা। একই অবস্থা পাটুরিযা-দৌলতদিয়া রুটে। চাঁদপুর-শরীয়তপুর রুটেও ছিল ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় গাড়ির দীর্ঘ সারি। সাভার, আশুলিয়া, টাঙ্গাইল, যমুনা-সেতুর দুই পার ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া অংশে ব্যাপক যানজট ছিল। এ ছাড়া গাজীপুরের বিভিন্ন সড়কেও তীব্র যানজট দেখা গেছে। ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট ছিল ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের টাঙ্গাইল অংশে।

লঞ্চ : ঢাকা নদীবন্দরে (সদরঘাট) যাত্রীর ভিড় থাকলেও তা স্বাভাবিক সময়ের থেকে খুব বেশি নয় বলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বন্দরে দক্ষিণবঙ্গমুখী যাত্রীরা জানান, লঞ্চগুলোয় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভিড় ছিল। যাত্রীরা মাস্ক পরে লঞ্চে উঠেছেন এবং লঞ্চেও মাস্ক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক (ট্রাফিক) জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘লঞ্চে আজ (শনিবার) যাত্রীর চাপ থাকলেও তা ঠিক ঈদের ভিড়ের মতো বলা যাবে না। এটা স্বাভাবিক সময়ের ভিড়ের চেয়ে একটু বেশি বলা যায়। আমরা যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করছি। মাস্ক ছাড়া কাউকে টার্মিনালে প্রবেশ করতে দিচ্ছি না। লঞ্চেও মাস্ক পরে থাকার জন্য লঞ্চ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সতর্ক করেছি। আমরা পর্যবেক্ষণে রাখার পাশাপাশি দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন। শুক্রবার মাস্ক না পরায় ১২ যাত্রীকে জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল ৪২টি লঞ্চ সদরঘাট টার্মিনাল ছেড়ে গেছে।’

ট্রেন : কমলাপুর ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোর মধ্যে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বগিগুলোয় যাত্রী কম থাকলেও উত্তরবঙ্গ ও রাজশাহীগামী ট্রেনগুলোর সাধারণ বগিতে প্রচ- ভিড় ছিল। মেল ও কমিউটার ট্রেনগুলোয় গাদাগাদি যাত্রী উঠতে দেখা যায়। বসা ছাড়াও স্ট্যান্ডিং যাত্রীও ছিল প্রচুর। দিনাজপুরের যাত্রী আশরাফ জানান, করোনার সময় স্ট্যান্ডিং টিকিট দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রতিটি বগিতে শত শত স্ট্যান্ডিং যাত্রী উঠেছেন। কোনো কোনো ট্রেনে দরজা এমনকি টয়লেটের সামনেও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। সার্বিক বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবস্থা নিতে। আন্তনগর ট্রেনে কোনো ঝামেলা নেই। স্টেশনেও সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই প্রবেশ করছেন। আমরা মাস্ক পরে স্টেশনে প্রবেশ ও যাত্রীদের মাস্ক পরার বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছি।’ লোকাল ও কমিউটার ট্রেনের বিষয়ে বলেন, ‘সব জায়গায়ই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য আমরা সতর্ক করছি। অনেক যাত্রীর চাপ থাকায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অনেক যাত্রী মাস্ক খুলে রাখছেন।’ প্রসঙ্গত, ঈদ উপলক্ষে ৩৮ জোড়া আন্তনগর ও ১৯ জোড়া মেল এবং কমিউটার ট্রেন চলছে।

বাস : সকাল থেকেই রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে বাস ছেড়ে যায়। সকালের দিকে যাত্রীর চাপ একটু বেশি থাকলেও দুপুরে কম দেখা গেছে সায়েদাবাদে। গাবতলীতে উত্তরবঙ্গমুখী যাত্রীরা সময়মতো বাস না আসার অভিযোগ করেছেন। যানজটের কারণে বাস ফিরে আসতে না পারায় উত্তরবঙ্গ ও দূরপাল্লার যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার টার্মিনালগুলোয় যাত্রীর বেশ চাপ ছিল। কিন্তু গতকাল যাত্রী ছিল খুবই কম। ফলে অনেক গাড়িকে আসন ফাঁকা রেখে ছাড়তে হয়েছে।’ আজ দুপুরের পর থেকে বাসে যাত্রী বাড়বে বলে জানান তিনি।

শিমুলিয়া ঘাটে উপচে পড়া ভিড় : মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শিমুলিয়া ঘাটে গতকালও দক্ষিণবঙ্গগামী মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় যানবাহনে যাত্রীরা শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটের শিমুলিয়া ঘাটে এসে উপস্থিত হন। তারা ফেরি ও লঞ্চে পদ্মা পারাপার হন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাপও বেড়ে যায়। এতে স্থানীয় প্রশাসন হিমশিম খায়। ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় অবস্থান করতে দেখা গেছে সহস্রাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি ও পণ্যবাহী ট্রাক। বিআইডব্লিউটিএর শিমুলিয়া নদী বন্দর কর্মকর্তা জানান, ৮২টি লঞ্চ ও ১৭টি ফেরি দিয়ে যাত্রী ও গাড়ি পার করা হচ্ছে।

বাংলাবাজার ঘাটে জনস্রোত : মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, বাংলাবাজার ঘাটে ঘরমুখো মানুষের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব বলে কিছুই ছিল না। গা ঘেঁষে যাতায়াত করছিল লোকজন। ঘাট এলাকায় সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। বিআইডব্লিউটিএ বাংলাবাজার লঞ্চঘাটের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আক্তার হোসেন বলেন, ‘সকাল থেকেই ঘরমুখো যাত্রীর ভিড়। যে লঞ্চগুলো আসা-যাওয়া করছে প্রতিটিতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী বহন করা হচ্ছে।’

পাটুরিয়ায় চাপ বেড়েছে : মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, যানবাহন ও যাত্রী পারাপারের জন্য ১৬টি ফেরি চলছে। সেগুলোয় ঘরমুখো মানুষের প্রচুর ভিড় দেখা যায়। যাত্রীবাহী বাহনের তুলনায় ট্রাক, ছোট গাড়ি ও মাইক্রোবাস বেশি দেখা যায়। বিআইডব্লিউটিসির ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ঘাটে তেমন সমস্যা নেই। তবে ফেরি না বাড়ালে আগামী দু-তিন দিন সমস্যা হতে পারে।’

সংকট কাটেনি দৌলতদিয়ায় : রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের একটি ফেরি বাড়ানোর পরও সংকট কাটেনি। পশুবাহী ট্রাক ও যাত্রীবাহী চাপের কারণে দৌলতদিয়া ঘাটে অচলাবস্থা দেখা দেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টার অপেক্ষা করে ফেরির নাগাল পাননি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছেড়ে আসা পশুবাহী ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাসের চালকরা। দুপুরে ৪ শতাধিক গাড়ি অপেক্ষা করতে দেখা যায়। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ম্যানেজার মো. শিহাব উদ্দীন জানান, স্রোতের কারণে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

গজারিয়ায় ১৩ কিলোমিটার যানজট : মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঘরমুখো মানুষের চাপে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার ভাটের চর থেকে মেঘনা-গোমতী সেতু পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার এলাকায় যানজট দেখা যায়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখো ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখো গাড়ির চাপ বাড়ায় এ যানজট। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ সেতুর সংস্কারকাজ চলায় যানজট বেড়েছে বলে গজারিয়া থানার ওসি কামাল হোসেন জানান।

টাঙ্গাইলে ২৫ কিলোমিটারে যানজট : টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে ২৫ কিলোমিটার এলাকায় ঢাকামুখো লেনে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া দিনভর থেমে থেমে যানজটের কারণে মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হয়। ঢাকামুখো গরুবাহী ট্রাকগুলোকে পড়তে হয় চরম বিপাকে। শুক্রবার ভোররাত থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আশেকপুর বাইপাস পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। মহাসড়কের রাবনা, বিক্রমহাটি, রসুলপুর, পৌলি ও এলেঙ্গায় এমন চিত্র দেখা গেছে। মাঝেমধ্যে উত্তরবঙ্গমুখো গাড়ি চললেও ঢাকামুখো লেনে গাড়ি আটকে ছিল দীর্ঘ সময়।

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম তীরে ধীরগতি : সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম মহাসড়কে ধীরগতিতে চলছে গাড়ি। সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে হাটিকুমরুল মোড় পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার এলাকা যেতে লাগছে ৫-৬ ঘণ্টা। উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকামুখো গরুবোঝাই ট্রাক, ঢাকা থেকে যাত্রীবাহীসহ পণ্য ট্রাকের চাপ বাড়ায় এ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে যাতে চালকরা ইচ্ছামতো ওভারটেক করে কৃত্রিম যানজট সৃষ্টি করতে না পারেন।

গাজীপুরে ব্যাপক চাপ : গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুর অংশে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা গেছে। গাড়ির চাপ বৃদ্ধি, বিআরটিএর নির্মাণ প্রকল্প চলমান এবং গাজীপুরা, চেরাগ আলী মার্কেট, টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ভাঙাচোরা থাকায় চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এসব স্থানে যানবাহন চলেছে থেমে থেমে। বিকালে এ সড়কের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ভোগড়া বাইপাস পর্যন্ত যানবাহনের চাপ বেশি দেখা গেছে।

শরীয়তপুর-চাঁদপুর নৌপথে গাড়িজট : শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কে যানবাহন চলাচল বেড়েছে। ওই সড়কের আলুর বাজার ফেরিঘাটে তীব্র যানজট দেখা গেছে। পারাপার না হতে পেরে অন্তত দেড় হাজার গাড়ি আটকা পড়ে। কোরবানির পশুবাহী গাড়ি আটকা পড়ায় গত দুই দিনে ১৮টি গরু মারা গেছে। অসুস্থ হয়েছে ৪০টি গরু।

সাভার ও আশুলিয়ায় তীব্র যানজট : সাভার প্রতিনিধি জানান, সাভার-আশুলিয়া সড়কে প্রায় ১৯ কিলোমিটার যানজট লেগেই থাকছে। এতে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়ার পাশাপাশি কোরবানির পশুবাহী গাড়িতে থাকা বেপারিরাও বিপাকে পড়েন। চন্দ্রা থেকে নবীনগর পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার যানজট, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগর থেকে হেমায়েতপুর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটারে যানজট লেগেই থাকছে। সাভার হাইওয়ে থানার ওসি সাজ্জাত হোসেন জানান, চন্দ্রা থেকে হেমায়েতপুর পর্যন্ত তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের সব সদস্যের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর