সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

উৎকণ্ঠা তিন খাত নিয়ে

গার্মেন্ট জনশক্তি বন্ধ হলে প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে, খাদ্য উৎপাদন বন্ধে দেখা দেবে সংকট

রুহুল আমিন রাসেল

উৎকণ্ঠা তিন খাত নিয়ে

ঈদের পর কঠোর বিধিনিষেধের লকডাউনে তিন খাত বন্ধ থাকলে অর্থনীতিতে ভয়াবহ আঘাত আসবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা ও খাদ্যপণ্য উৎপাদন সচল রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, উৎপাদন বন্ধ হলে এই মহামারীকালে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়তে পারে। একই সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানির পক্ষেও মতামত ব্যক্ত করেছেন ব্যবসায়ীরা। পোশাকশিল্পের ক্রয়াদেশ বাতিল হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমবে। জনশক্তি রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সে।

জানা গেছে, মহামারী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আগামী ২৩ জুলাই শুরু হওয়া কঠোর বিধিনিষিধের লকডাউন নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, আসছে লকডাউনের কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা নেই। কোন খাত খোলা থাকবে, কোন খাত বন্ধ থাকবে, পরিষ্কার নয়। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্যপণ্য, কৃষি ও উৎপাদনশীল শিল্প কারখানা এবং সকল প্রকার রপ্তানি খাত সচল রাখতে হবে। লকডাউন ও ঈদের ছুটিতে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প। উৎপাদন বন্ধ থাকলে বড় ধরনের হুমকিতে পড়তে হবে। বাড়বে ঝুঁকিও। মালিকরা ব্যবসা হারানোর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কঠোর বিধিনিষিধের লকডাউনের কারণে শিল্পকারখানাগুলোতে খাদ্যপণ্য উৎপাদন না হলে, বাজারে সংকট হবে এবং পণ্য সামগ্রীর দামও বাড়বে। দেশের উৎপাদনশীল সব ধরনের শিল্পকারখানা কভিডজনিত বিধিনিষেধের বাইরে রেখে সচল রাখতে হবে। বর্তমান কভিড পরিস্থিতিতে জীবন  রক্ষাকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হলে খাদ্য-পণ্যসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে সবাই বঞ্ছিত হবেন। সব প্রকার শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা হলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রাণশক্তি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে এবং সাপ্লাই চেইন (সরবরাহ ব্যবস্থা) সম্পূর্ণভাবে বিঘিœত হবে। এতে উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে, খাদ্যসামগ্রী, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বোতলজাত পানীয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ইত্যাদি উৎপাদন বন্ধ থাকলে ভোক্তা সাধারণ সমস্যার সম্মুখীন হবেন। পণ্যসামগ্রী সঠিকভাবে সরবরাহ ও বাজারজাত না হলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এতে স্বল্প আয়ের ক্রেতারা ভোগান্তির শিকার হবেন। দেশে খাদ্যপণ্য উৎপাদনের অন্যতম প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী বলেন, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ ও ঈদের ছুটিতে খাদ্যসামগ্রী ও ভোগ্যপণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন বন্ধ থাকলে, দেশে খাদ্যের ব্যাপক সংকট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের কৃষকরা। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানগুলো আম, দুধ, ফলমূল, শাকসবজিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ভোক্তার কাছে পৌছে দেয়। কিন্তু কারখানা বন্ধ থাকলে কোম্পানিগুলো এসব পণ্য কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করা বন্ধ রাখবে। এতে কৃষকের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

আহসান খান চৌধুরী আরও বলেন, কারখানায় পণ্য উৎপাদন না হলে ভোক্তাদের কাছে পণ্য পৌঁছাবে না। সম্পূর্ণভাবে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। পণ্য সঠিকভাবে সরবরাহ ও বাজারজাত করা না গেলে পণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে। এতে স্বল্প আয়ের ক্রেতারা ভোগান্তিতে পড়বেন। যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পণ্য রপ্তানি করে থাকে, তাদের জন্য বাজার হারানোর পরিস্থিতি তৈরি হবে। কেননা পণ্য উৎপাদন না করা গেলে আমদানিকারকদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া করোনাকালে বেশ কিছু নতুন দেশ বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি শুরু করছে। কিন্তু তারা শুরুতে ধাক্কা খেলে বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে যার সুযোগ নেবে প্রতিযোগী দেশসমূহ।

এদিকে দেশের উৎপাদনশীল সব প্রকার শিল্পকারখানা কভিডজনিত বিধিনিষেধের বাইরে রেখে সচল রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই। সংগঠনটি বলেছে, কভিড বিস্তার রোধে জারিকৃত বিধিনিষেধ সংক্রান্ত সার্কুলারে ওষুধ কারখানা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। যদি ওষুধ কারাখানা বন্ধ রাখা হয়, তবে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। অপরদিকে ট্যানারি কারখানা বন্ধ রাখা হলে কোরবানি ঈদে সংগৃহীত চামড়া সংরক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। এক মাসের রপ্তানি শিডিউল বিঘিœত হলে পরবর্তী ছয় মাসের রপ্তানি শিডিউলে নেতিবাচক প্রভাব পরবে। সেই সঙ্গে উৎপাদন বন্ধ থাকলে আমদানিকৃত কাঁচামাল অব্যবহৃত হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে আমদানিকারক ও উৎপাদক উভয়ই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও ছোট কারখানাসমূহ বন্ধ রাখা হলে উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং কারখানাসমূহ পুনরায় চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যদি উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়, তাহলে অর্থনীতির চলমান গতিধারা ব্যাহত হবে। জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকেও সচল রাখতে উৎপাদন ব্যবস্থাকে চলমান রাখা জরুরি। অপরদিকে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ঈদ ও লকডাউন কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন কর্মমুখর হাজার হাজার পোশাক কারখানা বন্ধ রাখা হলে, ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। আমরা ক্রয়াদেশ হারাব, যা দেশের জন্য ভালো হবে না। এক কথায় বলতে পারি লকডাউনে শিল্প বন্ধ রাখলে পরিস্থিতি ভালো হবে না।

বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ঈদ ও লকডাউনের দীর্ঘ ছুটিতে পোশাক পণ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্রয়াদেশ বাতিল হবে। সময়মতো পণ্য ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করতে না পারলে ঝুঁকি বাড়বে। এতে বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতি হবে। উদ্যোক্তারা বিপাকে পড়বেন। দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকলে পোশাকশিল্প হুমকিতে ফেলে দেওয়ার ঝুঁকি আছে।

এর আগে ঈদসহ প্রায় ২০ দিনের ছুটিতে দেশের রপ্তানি খাত দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন তৈরি বস্ত্র ও পোশাকশিল্প খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের পাঁচটি সংগঠন প্রধানমন্ত্রীকে গত ১৫ জুলাই দেওয়া যৌথ চিঠিতে বলেছে, কারখানা বন্ধ থাকলে এক অনিশ্চয়তার মাঝে লেইট সামার, ক্রিসমাস ও বড়দিন এবং আগামী শীতের কার্যাদেশসমূহ হাতছাড়া হয়ে যাবে। কারণ এক মাসের রপ্তানি শিডিউল গড়বড় হলেই পরবর্তী ছয় মাসের রপ্তানি শিডিউলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর সুযোগ নিবে আমাদের প্রতিযোগী দেশসমূহ। এমতাবস্থায় ছুটি সংক্ষিপ্ত করে রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানাসমূহ যত দ্রুত সম্ভব ঈদের পরে খুলে দিলে দেশের রপ্তানি খাত বহুমুখী বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাবে। বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান, বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বিটিটিএলএমইএ সভাপতি শাহাদাত হোসেন সোহেল এবং বিজিএপিএমইএ সভাপতি আবদুল কাদের খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে আরও বলা হয়- পোশাকশিল্পে এখন কাজের প্রচুর চাপ থাকায় ঈদে লম্বা ছুটির সুযোগ নেই। কিন্তু ২৩ জুলাই থেকে কারখানা বন্ধ হলে কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকদের কর্মস্থলে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। ছুটে যাবে উত্তরাঞ্চল-দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফলে কভিড সংক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়াবার। ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের সব বাজারই খুলতে শুরু করেছে। এখনই প্রত্যেকের হাতে রয়েছে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ, রয়েছে জাহাজীকরণের প্রচ- চাপ, বিলম্ব হলেই এয়ার শিপমেন্ট ধরিয়ে দিতে কাল বিলম্ব করছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর