সোমবার, ২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বেপরোয়া হুইপ পোষ্যের টিকা বাণিজ্যে তোলপাড়

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী

বেপরোয়া হুইপ পোষ্যের টিকা বাণিজ্যে তোলপাড়

চট্টগ্রামের পটিয়ায় হুইপের বেপরোয়া পোষ্যের ‘টিকা বাণিজ্যে’র বলি হলেন করোনা টিকাপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভাগীয় পরিচালক কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্তেও হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর এলাকায় টিকাদানে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ধরা পড়েছে। উঠে এসেছে অনিয়মের চিত্র।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের কোথাও ৮ আগস্টের আগে টিকা দেওয়ার কথা নয়। কোনো এমপি কর্তৃক সরকারি এই টিকাদান কর্মসূচি দলীয় ব্যানারে উদ্বোধনের কথা নয়। অথচ হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি এই টিকাদান কর্মসূচির দলীয় আয়োজন উদ্বোধন করেছেন। এ নিয়ে হুইপপন্থি আওয়ামী লীগ সামাজিক মাধ্যমসহ নানাভাবে হুইপের প্রচারণাও চালায়। হুইপ তার সমর্থকদের নিয়ে টিকাদান কর্মসূচি পরিদর্শনও করেন। গতকাল তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালেও এসব তথ্য নিশ্চিত হন।

তদন্ত কমিটি হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ইউনিয়নে বিধিবহির্ভূতভাবে ২ হাজার ৬০০ টিকা প্রদানের আলামত পায়। জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত রবিউল হুসাইন অনুমোদনহীন এই টিকাদানে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সরকারিভাবে আগামী ৮ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনার টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। কিন্তু এর আগেই ঘটা করে হুইপের প্রচারের জন্যই গত ৩০ ও ৩১ জুলাই পটিয়ার শোভনদন্ডী ইউনিয়নে এরকম টিকা বাণিজ্য হয় বলে স্থানীয়রা জানান। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এরকম বাছবিচারহীনভাবে একটি ইউনিয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদানের ঘটনা নজিরবিহীন। এর মধ্য দিয়ে পটিয়ার অন্য ইউনিয়নের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সূত্রের দাবি, হুইপ পোষ্যের এমন টিকা বাণিজ্যে মূলত বলি হলেন সাধারণ পটিয়াবাসী। হুইপ সামশুল হকের প্রভাবে চাকরি পাওয়া কথিত ছাত্রলীগ নেতা ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) রবিউল হুসাইনের বিরুদ্ধে উঠেছে এই টিকা বাণিজ্যের ভয়াবহ অভিযোগ। রবিউল প্রথম পর্যায়ে টিকা প্রদানকালেও অর্থের অবৈধ লেনদেনে জড়িত ছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তার দোর্দ- প্রতাপে যেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীলরাও অসহায়। স্থানীয় সূত্র জানায়, হাসপাতালে খাদ্য ও সরঞ্জামসহ নানা সরবরাহ কাজে হুইপ সামশুল হকের হয়েই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এই রবিউল হুসাইন। হুইপ সমর্থিত এই ছাত্রলীগ নেতা দাবিদারের ‘টিকাবাণিজ্য’ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। প্রাথমিকভাবে রেজিস্ট্রেশনহীন এবং বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থের বিনিময়ে ৭০০ টিকা প্রদানের অভিযোগ উঠলে গতকাল তদন্তের প্রথম দিনেই এই সংখ্যা ২৬০০ বলে তথ্য মেলে। খোদ হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নিজের ইউনিয়ন শোভনদন্ডীতে এ ঘটনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই যেন বিতর্কে ফেলেছে। গতকাল তদন্ত কমিটি গঠন করেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শাহরিয়ার হাসান শাহরিয়ার কবির। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী জানান, তিন সদস্যের গঠিত এই তদন্ত কমিটিকে দুই দিনের সময় দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল এ তদন্ত রিপোর্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরের চট্টগ্রামের পরিচালক বরাবর জমা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। সিভিল সার্জন আরও বলেন, প্রয়োজন হলে তদন্তের সময় বাড়ানোও হতে পারে। তিনি জানান, টিকাদান প্রক্রিয়ায় অনিয়ম প্রমাণিত হলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্ত কমিটির সদস্য ডা. অজয় দাশ জানান, বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত টানা চার ঘণ্টা এই টিকাদান প্রক্রিয়ায় জড়িতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

ঘটনা যে হয়েছে, তা সত্যি। তবে কী পরিমাণ টিকা প্রদানের অভিযোগের সত্যতা আছে, তা টিকা গ্রহণকারীদের সম্মতিপত্রের বারকোড মিলিয়ে দেখাসহ অন্যান্য নিরীক্ষণ করা হবে। টিকা প্রদানের প্রথম পর্বের পুরনো কাগজগুলোও মিলিয়ে দেখা হবে।

এদিকে পটিয়া স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ এ প্রতিবেদককে জানান, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ইপিআই) রবিউল হোসেনের বিরুদ্ধে অনুমোদন ছাড়া টিকা প্রদান, অর্থ আদায়সহ সুনির্দিষ্ট নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে অভিযুক্ত রবিউল হোসেনকে মুঠোফোনে তার বক্তব্য জানতে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও দিনভর সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে তিনি জানান, এ টিকা প্রদানের বিষয়টি আগে থেকেই হুইপকে অবগত করা ছিল। রবিউল নিজের এলাকায় টিকা দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

রবিউল হোসেন নিজেই সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডি থেকে হুইপ সামশুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ছবি প্রকাশ করেছেন এবং টিকা প্রদান কর্মসূচিতে হুইপের সম্মতি ও উপস্থিতির কথা জানান। 

বিভিন্ন সময়ে হুইপপন্থি ছাত্রলীগের ‘সভাপতি’ বলেও দাবি করেন রবিউল। গত বৃহস্পতিবার থেকে এই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূতভাবে টিকা দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠলেও শনিবার পর্যন্ত তার তত্ত্বাবধানে টিকা দেওয়া হয় হুইপ সামশুল হকের নিজের ইউনিয়ন শোভনদন্ডীতে। দেশজুড়ে যখন টিকা নিয়ে সংকট-উৎকণ্ঠা, তখন সরকারি বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থ নিয়ে এমন টিকা প্রদানের ঘটনায় এলাকাবাসীর মনে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর