মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
বঙ্গবন্ধুর সময়ে ছাত্ররাজনীতি

বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও দেশকে ভালোবাসার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে বলতেন বঙ্গবন্ধু

শেখ শহীদুল ইসলাম

বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও দেশকে ভালোবাসার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে বলতেন বঙ্গবন্ধু

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি তাঁর ছাত্রজীবন থেকে। উচ্চশিক্ষার্থে ১৯৪২ সালে জাতির পিতা কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। কলেজটি ছিল তৎকালীন মুসলিম লীগের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এ কলেজের ছাত্রত্বের সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। একই সময়ে তাঁর রাজনীতিকে প্রভাবিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সংগ্রামী চেতনা। তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং সরাসরি ছাত্র রাজনীতিতে তথা মুসলিম লীগের রাজনীতিতে নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের সৃষ্টি হলে তিনি বাড়ি ফিরে এসে আইন পড়তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ওই বছরের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গ্রেফতার হন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। বঙ্গবন্ধু ছাত্র রাজনীতিতে যে ধারার প্রবর্তন করেছিলেন তা গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ধারা। তৎকালীন রাজনীতি ছিল উচ্চবিত্তদের দখলে। জাতির পিতা সেই রাজনীতিকে মধ্যবিত্তের মধ্যে নিয়ে আসেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ হলো; এ দলটিই পাকিস্তানের একমাত্র বিরোধী দল যার যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। ১৯৫৩ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণের কারণে প্রত্যক্ষভাবে আর ছাত্র রাজনীতি করেননি। তবে রাজনৈতিক শক্তি ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের লক্ষ্যে ছাত্রদের তিনি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করার পক্ষে ছিলেন। তিনি যে ছাত্র রাজনীতির কথা চিন্তা করতেন সে রাজনীতির কয়েকটি লক্ষ্য ছিল।

এর মধ্যে এক. ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি সৃষ্টি করা, যাতে তারা আগামীতে দেশ ও জাতির কল্যাণে জাতীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেন। দুই. ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম সঞ্চার করা, যাতে ছাত্রসমাজ দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের প্রতিভা ও মেধাকে কাজে লাগাতে পারেন। তিন. তৎকালীন প্রেক্ষাপটে ছাত্রসমাজ ছিল দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। যারা রাজনীতি সম্যক উপলব্ধি করতে পারতেন। চার. ছাত্রসমাজের যেহেতু পারিবারিক দায়দায়িত্ব কম ছিল সেহেতু তারা রাজনৈতিক ঝুঁকি গ্রহণে সক্ষম ছিলেন। ছয়. জনগণের কল্যাণে ছাত্রসমাজকে আগামীতে কাজ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগকে সব সময় অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন জাতির পিতা। তিনি ছাত্রলীগকে উদ্বুদ্ধ করেছেন দেশপ্রেম ও এ দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে কাজ করতে। ছাত্রলীগকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বাঙালির মুক্তিকামী জনতার অগ্রগ্রামী প্রতিষ্ঠান। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর আওতায় আওয়ামী লীগের পক্ষে অনেক বক্তব্য প্রদান করা সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধু সে বক্তব্যগুলো ছাত্রলীগের মাধ্যমে জনসমক্ষে নিয়ে আসতেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন ও ’৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ তথা সামগ্রিক ছাত্র আন্দোলনকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা দেন। ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তাঁর এ কর্মসূচিকে সর্বপ্রথমে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। পরে একে আওয়ামী লীগও তাদের দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে। ছয় দফা ছিল মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ ছয় দফা প্রণয়নের পরই এ দেশের রাজনীতিতে কিছু আদর্শগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে ছাত্রলীগই প্রথম জাগো জাগো বাঙালি জাগো, পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা, পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা এ ধরনের জাতীয়তাবাদী স্লোগান রাজনৈতিক অঙ্গনে নিয়ে আসে। এতে ক্রমে শানিত হয় বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। যার ফলে ভীতসন্ত্রস্ত হয় পাকিস্তানি শাসক-শোষক চক্র। তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে এবং আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রেফতার হন অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি করে তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর চেষ্টা করে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগসহ অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের ঐক্যজোট ছয় দফাসংবলিত ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে তুমুল আন্দোলন শুরু করে; যা একপর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এ ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকেই বঙ্গবন্ধুকে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের কাছ থেকে যে রাজনীতি প্রত্যাশা করেছিলেন তা পরে তাঁর কয়েকটি ভাষণে প্রতিফলিত হয়। তিনি ছাত্রদের প্রথমত দেশপ্রেম ও জনকল্যাণের মন্ত্রে দীক্ষিত করতেন। ছাত্রদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আগামীতে দেশের নেতৃত্ব গ্রহণে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্‌বান জানাতেন। ছাত্রদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় আগ্রহী করার সঙ্গে সঙ্গে দেশ ও জনগণকে ভালোবাসার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে বলতেন। দেশের জনগণকে ভালোবাসতে বলতেন। তাদের পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালন করতে বলতেন। ১৯৭৩ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে যে কবিতাটি থেকে উদ্ধৃতি দেন তাতে ছিল- ‘পরহিংসা পরদেশ, কভু নাই এনুমনে, কভু না করিও লোভ, তুমি পরধনে’। এর মধ্য দিয়ে তিনি ছাত্রসমাজের চরিত্র গঠনে একটি অমর বাণী রেখে গেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশ ও জাতির জন্য তাঁর সর্বোচ্চ ত্যাগ, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার এক মরণজয়ী আদর্শ ছাত্রসমাজের সামনে রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যারা তাঁকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল তারা জানত না, মুজিব আদর্শ কালোত্তীর্ণ এক মন্ত্র যা যুগে যুগে ছাত্রসমাজকে অনুপ্রাণিত করবে। প্রত্যেক জাতির সামনে অনুসরণীয় কিছু ব্যক্তিত্ব থাকেন, যাঁকে অনুসরণ করে পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদের প্রস্তুত করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষত ছাত্রসমাজের জন্য একজন মহাপুরুষ। বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এ সন্তান অনাগত ভবিষ্যতেও অতীতের মতো ছাত্রসমাজ তথা জনগণকে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মোৎসর্গের শিক্ষা দিয়ে যাবেন। আদর্শ অবিশ্বর, অনুপ্রেরণাদায়ক এবং মানবতাবাদী। আমরা যত দিন এ আদর্শ নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারব তত দিন বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি পৃথিবীর বুকে গৌরবের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। এই মহান নেতার সৃষ্টি অমর হোক।

অনুলিখন : রফিকুল ইসলাম রনি

সর্বশেষ খবর