বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বস্তিবাসীদের ফ্ল্যাট হস্তান্তর

কেউ গৃহহীন থাকবে না : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

কেউ গৃহহীন থাকবে না : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বস্তিবাসীদের জন্য ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতার এই দেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না। বস্তিবাসীদের যারা গ্রামে ফিরে যাবেন, সরকারের তরফ থেকে জমিসহ ঘর, ঋণ দেওয়া হবে। প্রয়োজনে তাদের ছয় মাসের খাবার বিনামূল্যে দেওয়া হবে। 

মুজিববর্ষ উপলক্ষে গতকাল ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ঢাকায় নির্মিত ২ হাজার ৪৭৪টি ফ্ল্যাট সংবলিত পাঁচটি আবাসন প্রকল্প’ এবং মাদারীপুরে নির্মিত সমন্বিত অফিস ভবন উদ্বোধন’ এবং ‘জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের স্ব-অর্থায়নে বস্তিবাসীদের জন্য মিরপুরে নির্মিত ভাড়াভিত্তিক ৩০০টি ফ্ল্যাট’ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকলে এ দেশের মানুষ আরও আগেই সুন্দর জীবন পেত, এমন আক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের প্রত্যেকটা মানুষ সুন্দর ও উন্নত জীবন পাবে, জাতির পিতা সে স্বপ্নই দেখতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার ফলে সেটা পেলাম না। আমরা তার সেই কাজই করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, জাতির পিতা জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য। তিনি সব সময় একটি কথাই বলতেন, আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ অন্ন পাবে, বস্ত্র পাবে, তারা উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। এই বাংলাদেশের মানুষ রোগে-শোকে ছিল। শিক্ষার আলো পেত না। তাদের ভাগ্যোন্নয়ন করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য। এ জন্য ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি থেকে তিনি ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে?মুক্ত ও স্বাধীন করেছেন। আর এই দাবির সংগ্রামের মধ্যেই তাকে জেলে নিয়েছে, নির্যাতন করেছে, হত্যা করতে চেয়েছে।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমিহীনদের ঘর করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সাড়ে তিন বছর একটা রাষ্ট্রের জন্য কম সময়। তখন তো একটা প্রদেশ ছিল, সেটা দেশে উন্নীত করা ও গঠন করা; এটা তিনি করে গেছেন। কিছু বেইমান মোনাফেকের জন্য তার ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠন সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, জাতির পিতার হত্যাকান্ডের সময় আমরা তখন দেশের বাইরে ছিলাম। আমার দল ও বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় ফিরে আসি। আমার আসার পথ সহজ ছিল না। তৎকালীন ক্ষমতা দখলকারীরা নানা বাধা সৃষ্টি করেছে। আজকে আমরা ক্ষমতায়। সরকারে থেকে তৃণমূল মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা, তাদের জীবন-মান উন্নত করা এবং সংবিধানের আলোকের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণা করে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে আমরা কাজ করাব, তাদের ভালোমন্দও তো দেখতে হবে। আজিমপুর সরকারি কলোনিতে গ্যাস ছিল না, আমিই আব্বাকে বলে সে গ্যাসের লাইন করে দিয়েছিলাম। আমি সরকার গঠন করে উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সবাইকে ফ্ল্যাট করে দেব। সুন্দর পরিবেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেব, যাতে কর্মকর্তারা ভালোভাবে কাজ করতে পারে। তিনি বলেন, প্রত্যেকটা মহকুমাকে জাতির পিতা জেলায় রূপান্তর করেন। জেলা গভর্নর নিয়োগ দেন। যেন প্রত্যেকটা জায়গা পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠতে পারে। পঁচাত্তরের পর এ পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলা হয়। এখন আমরা সে ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রথমে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন কমপ্লেক্স করে দিয়েছি। যাতে এক জায়গা থেকে সব সেবা পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ঘরে ফেরা কর্মসূচি নিয়েছি। কোনো বস্তির বাসিন্দা যদি নিজ গ্রামে যায়, তাকে ঘর করে দেওয়া, কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ করে দেব, ঋণ দেব। বস্তিতে তারা মানবেতর জীবনযাপন করেন, এটি অস্বাস্থ্যকর ও বসবাসের অনুপযোগী। এ জন্য তাদের জন্য সুন্দর ও আধুনিক ব্যবস্থাপনায় থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আজকে ৩০০ পরিবারকে ৩০০ ফ্ল্যাট দিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ফ্ল্যাট দেব। কেউ গ্রামে যেতে চাইলে সে ব্যবস্থাও করব। গ্রামে ঘরবাড়ি করে দেব। ঢাকায় ফ্ল্যাটে থাকলে মাসে ভাড়া দিয়ে থাকতে হবে। গ্রামে গেলে সব বিনামূল্যে করে দেওয়া হবে। আমাদের লক্ষ্য, একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। তিনি বলেন, পূর্বাচলে যাদের জমির মালিকানা ছিল, তাদের একটা করে প্লট দেওয়ার কথা ছিল। সেটা কেউ করেনি। আমাদের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নামমাত্র মূল্যে তাদের প্লটগুলো দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রশাসনের জেলাভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকান্ড এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সে কারণে সরকার এমন ব্যবস্থা করতে চায়, যাতে সরকারি কর্মচারীদের কাজের সুবিধা হয়, আবার জনগণও যাতে একবারে এক জায়গায় সব ধরনের সরকারি সেবা পায়। তিনি বলেন, আজকে আমরা মাদারীপুরে সমন্বিত সরকারি অফিস অর্থাৎ সব কাজ চলবে একই বিল্ডিংয়ে। প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে কাজ করবেন, আর যে সরকারি সেবা পেতে যাবেন, এক জায়গায় গিয়েই সব কাজ পাবেন। তাতে যেমন রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম কমবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উপরও চাপ পড়বে না। যারা যাবেন, তাদের যাতায়াতের খরচটাও বেঁচে যাবে। ওখানে বসে, এক জায়গায় বসে তারা সব কাজ করে আসতে পারবেন। একটা সমন্বয় থাকবে। এ ধরনের সমন্বিত অফিস হলে যে জমিরও সাশ্রয় হবে, সে কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব সময় এটা মাথায় রাখতে হবে, জমির সাশ্রয় করা। সেজন্য এটা মাদারীপুরে প্রথম করলাম। পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক জেলায় আমরা করব, প্রতি উপজেলায় করে দেব। কারণ উপজেলায় শুধু সরকারি অফিস না, আমি চাচ্ছি যে প্রত্যেক উপজেলায় ফ্ল্যাট তৈরি করে দেব। কারণ অনেক চাকরিজীবীকে সেখানে যেতে হয়, থাকার অসুবিধা, ভালো বাড়ি ভাড়া পান না, নানা অসুবিধায় পড়তে হয়। সেদিকে বিবেচনা করে আমরা সেটাও করে দেওয়ার চিন্তা করছি।

সরকারি কর্মচারীরা যাতে ভালো পরিবেশে থাকতে পারেন, তাদের মেধা ও শক্তির পুরোটা কাজে লাগাতে পারেন, সেটাই সরকারের লক্ষ্য বলে মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে আমাদের সরকারি কর্মচারী প্রয়োজন। আমাদের সংবিধানে কিন্তু সরকারি অফিসারদের সরকারি কর্মচারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে কে উঁচু কে নিচু সেটা দেখা হয়নি। আমরা যখন সরকার গঠন করি, তাদের যখন কাজ করাই, তো তাদের ভালো মন্দটাও আমাদের দেখতে হবে।

স্বাধীনতার পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনমানের উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমি সরকার গঠন করার পর দেখেছি যে আমাদের সরকারি অফিসাররা একবার একটা বাসা পেলে তার যতই প্রমোশন হোক, সেখানেই সে থাকবে, কারণ পরে ভালো বাসা পাবে কি না তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আমি সরকার গঠন করার পর থেকে উদ্যোগ নিই যে সবার জন্য আবাসন ব্যবস্থা করে দেব এবং ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্দেশ্য এ জন্য যে আমাদের ভূমির পরিমাণ কম, জনসংখ্যা বেশি। সাড়ে ৭ কোটি থেকে এখন সাড়ে ১৬ কোটির উপরে মানুষ। কাজেই আমাদের সরকারের পরিধিও বেড়েছে, কাজের পরিধি বেড়েছে। আমাদের সরকারি কর্মচারীর সংখ্যাও বেড়েছে। সেটা বিবেচনা করে আমরা ঠিক করলাম যে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেব। বিভিন্ন পর্যায়ের যারা আছেন উচ্চপদস্থ, সেই উচ্চপদস্থ থেকে নিম্ন পর্যায়ের সবার জন্যই ফ্ল্যাট বাড়ি করে সবাইকে একটা সুন্দর পরিবেশে থাকার ব্যবস্থা করে দেব, যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারেন।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ অনুষ্ঠানে বক্তৃা করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার স্বাগত ভাষণ দেন। অনুষ্ঠানে প্রকল্পগুলোর ওপর ভিডিও চিত্রও পরিবেশিত হয়।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কয়েকজন বস্তিবাসীর মাঝে ফ্ল্যাটের বরাদ্দপত্র হস্তান্তর করেন। প্রায় ছয় বিঘা জমির প্রকল্পে ১৪ তলার পাঁচটি ভবনে তৈরি করা হয়েছে ৫৩৩টি আধুনিক ফ্ল্যাট। লিফট, জেনারেটর, সৌরবিদ্যুৎ, প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, বিদ্যুতের সাবস্টেশন ও সৌন্দর্যবর্ধনের লাইটিংসহ আধুনিক নগর জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই রয়েছে। পরিকল্পিত ও আধুনিক আবাসনের ছোঁয়ায় রাজধানীর মিরপুরের ১১ নম্বর সেকশনে এই ফ্ল্যাটগুলো তৈরি করা হয়েছে। ১৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা ফ্ল্যাটগুলো পাচ্ছে বস্তিতে বসবাসকারীরা। বস্তিবাসীদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ফ্ল্যাটগুলো বিনামূল্যে নয়, ৪ হাজার ৫০০ টাকা মাসিক ভাড়ায় থাকবেন। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আয়তন ৬৭৩ বর্গফুট। প্রতিদিন ১৫০ টাকা কিংবা সপ্তাহে ১ হাজার ৫০ টাকা করে ফ্ল্যাটের ভাড়া পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর