শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

জাতির পিতা রাজনীতিকে আন্দোলনমুখী করেছিলেন বলেই দ্রুত স্বাধীনতা

আমির হোসেন আমু

জাতির পিতা রাজনীতিকে আন্দোলনমুখী করেছিলেন বলেই দ্রুত স্বাধীনতা

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাদের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ব্রিটিশরা যখন চলে যায়, বৃহত্তর বাংলা যেন ভাগ না হয় সে জন্য তখন থেকেই একটা আন্দোলন ছিল। এর সঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ অনেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুও         এ রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। তারপরও বড় নেতৃত্বের ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলা ভাগ হলো। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ ছয়জনকে বাংলাদেশের কোটায় গণপরিষদের সদস্য করে নেওয়া হলো। এরপর সবার মতামতকে উপেক্ষা করে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার পরিকল্পনা করা হলো। এর মূলে ছিল বাঙালি জাতিকে শাসন ও শোষণ করার পরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধু এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনীতিটা আন্দোলনমুখী করে তোলেন। নিজে সেইভাবে প্রস্তুতি নেন, দলকে প্রস্তুত করেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানিরা যে আমাদের উপেক্ষিত করছে, আমাদের শোষণ, শাসন করছে তা প্রতিটি জনসভা, দলীয় সভায় তুলে ধরতেন। তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতেন। নিজেকে তিনি বাঙালি আদর্শবান নেতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে। সে কারণেই দ্রুত স্বাধীনতা পাই আমরা। আওয়ামী লীগ তার সৃষ্টি থেকেই স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে আসছে। স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা কী সেটা কেউ পরিষ্কার করেননি। পরবর্তীতে জাতির পিতা ছয় দফা যখন দিলেন, এটাই যে স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা তা তিনি বাঙালিকে  বোঝাতে সক্ষম হন। পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা যাবে না, তারা আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে যে শোষণ ও শাসন করছে তা বারবার বোঝানো হতো। ছয় দফা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিরা লুফে নেন। এর সমর্থনে সবাই এগিয়ে আসলেন। কিন্তু পাকিস্তান তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় মোকাবিলা করার ঘোষণা দিলেন। গভর্নর মোনায়েম খানও একই কথা বললেন। তারা (পাকিস্তানিরা) বলা শুরু করল, এটা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাবি, এটা গ্রহণ করা যায় না। বঙ্গবন্ধু যখন লাহোরে ছয় দফা প্রস্তাব নিয়ে গেলেন, তখন সমর্থন করেননি তারা। সেখানে যে বাঙালি নেতারা গিয়েছিলেন, তারাও সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করেননি। এরপর জাতির পিতা যখন দেশে ফিরে বিমানবন্দরে বিষয়টি সাংবাদিকদের সঙ্গে তুলে ধরলেন, আবার ঝটিকা সফর শুরু করলেন, সেই সফরের মধ্যে বাঙালির মধ্যে ছয় দফা নিয়ে জনমত গঠন করতে সক্ষম হলেন। এই জনমত গঠনের সময় তাঁকে বারবার গ্রেফতার করা হলো। তিনি বারবার উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বিভিন্ন জনসভায় যোগদান করতেন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জের জনসভা শেষে জাতির পিতা ঢাকায় ফিরলেন। ৯ মে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার থাকাকালীন দুই বছর কারাগারে রাখার সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া হয়। তিন মাস তাকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তা কেউ জানে না। পরিবারকে জানানো হয়নি। কোনো নেতা-কর্মীও জানতেন না বঙ্গবন্ধু কোথায়? এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব বিবৃতি দিয়েছেন। পরবর্তীতে আইয়ুব খানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বঙ্গবন্ধুর নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হচ্ছে। এই ঘোষণা দেওয়ার পরপর বাঙালিরা রাস্তায় নেমে আসেন। তারা বুঝতে পারেন, বাঙালির মুক্তি চাওয়া এবং ছয় দফা ঘোষণার কারণে মিথ্যা মামলা দিয়ে জাতির পিতাকে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হবে। এর বিরুদ্ধে প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধু এবং ছয় দফার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। আন্দোলনের গতিবিধি বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক সমাজই তখন সবচেয়ে বেশি বড় ভূমিকা রাখে ছয় দফার পক্ষে। শ্রমিকরা প্রথম জীবন দেয়। তাদের কারণেই তৃণমূলে ছয় দফা পৌঁছানো সম্ভব হয়। পরবর্তীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার জজের এজলাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আইয়ুব খানের ১০ মন্ত্রীর বাসায় আগুন দেওয়া হয়। আন্দোলন তীব্র হলে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। যদিও প্রথমে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জাতির পিতার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা রাজি হননি। পরে বঙ্গবন্ধুকে মামলা প্রত্যাহার করে তাকেসহ তাঁর ৩৪ জন সহকর্মীকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আগরতলা থেকে যেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বের হন, সেদিন থেকেই তিনি অলিখিত রাষ্ট্রপ্রধান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতির পিতার নেতৃত্বে কাতারবন্দী তা প্রমাণিত। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আবারও তা প্রমাণিত হয়। এ সময়ে অনেক দল অনেক কথা বলল। কিন্তু জাতির পিতা বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের ম্যান্ডেট আগে নিতে হবে। তাই তিনি ভোটে গেলেন। কিন্তু তার আগে ১১ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে ৫-৭ লাখ মানুষ মারা গেল। এ নিয়ে পাকিস্তানিরা নির্বাচন দেবে না-নানা টালবাহানা শুরু করল। কিন্তু জাতির পিতা একটা আন্তর্জাতিক প্রেস কনফারেন্স করে জানিয়ে দিলেন, ভোট নিয়ে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র হলে ৫ লাখের কাছে ১০ লাখ মানুষ জীবন দেবে। বাংলাদেশ স্বাধীন করবে। নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এরপর পাকিস্তান বুঝতে পারল, ছয় দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র পরিচালিত হলে পাকিস্তান থাকে না। তাই নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পরবর্তীকালে সংসদ অধিবেশন বন্ধ করে দেয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সংসদ অধিবেশন ডেকেছিল, জাতির পিতা চার দফা দাবি পেশ করলেন : সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নিতে হবে। সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। বাংলার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার নিরপেক্ষ তদন্ত করে বিচার করতে হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এর মাধ্যমে জাতির পিতা সরাসরি নেগেট করেননি, কিন্তু নেগেটের কথাই বলে দিলেন। এরপর ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা গেরিলা যুদ্ধের সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গ্রামগঞ্জে পাড়া মহল্লায় সংগ্রাম প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিলেন। জাতির পিতা জানতেন, তাঁকে হয়তো গ্রেফতার করা হতে পারে, অথবা মেরে ফেলা হতে পারে। সে কারণেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। সে সময়ে পাকিস্তান থেকে যারা আলোচনার জন্য এসেছিলেন, তারাও বলেছিলেন, একমাত্র ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া কোথায়ও পাকিস্তানের পতাকা নেই। ৩২ নম্বর থেকে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হতো সেভাবেই দেশ চলত। অর্থাৎ তখন জাতির পিতা দেশ চালাতেন। ২৫ মার্চ রাতে জাতির পিতা দেশকে স্বাধীন দেশ ঘোষণা করলেন। তার কাক্সিক্ষত স্বপ্নপূরণ হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পাই।

অনুলিখন : রফিকুল ইসলাম রনি

সর্বশেষ খবর