মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

রাজ-পিয়াসাদের অঢেল সম্পদের সন্ধান

বিএমডব্লিউ হ্যারিয়ারসহ ৪ বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ, তদন্তে বেরিয়ে আসছে অস্ত্র সোনা অর্থ আর নারী পাচারের তথ্য, পরীমণি-হেলেনাদের সব মামলা তদন্ত করতে চায় র‌্যাব, বাসায় যাতায়াত ছিল এমন তালিকা হচ্ছে না : ডিএমপি কমিশনার

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজ-পিয়াসাদের অঢেল সম্পদের সন্ধান

কথিত মডেল পিয়াসা, মৌ, রাজ মাল্টিমিডিয়ার নজরুল ইসলাম রাজ, মিশু হাসান ও জিসানের অঢেল সম্পদের সন্ধান পাচ্ছে গোয়েন্দারা। এর মধ্যে গত রবিবার পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ সিআইডি পিয়াসা এবং রাজের চারটি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করেছে। এগুলো হচ্ছে দুটি বিএমডব্লিউ, একটি হ্যারিয়ার এবং একটি মাজদা গাড়ি। এর মধ্যে একটি বিএমডব্লিউ ও একটি মাজদা গাড়ি পিয়াসার। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেফতারদের সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবসা না থাকলেও কীভাবে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেলেন, তা তদন্ত করতে গিয়ে হতবাক করার মতো তথ্য পাওয়া গেছে। ভয়াবহ এই সিন্ডিকেট মাদকের আসরে বিত্তশালীদের শুধু ব্ল্যাকমেলিং করেনি, তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর আরও ভয়ংকর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অস্ত্র ও সোনা-হীরা চোরাচালান এবং অর্থ ও নারী পাচারের বেশ কিছু তথ্য তদন্তে বেরিয়ে আসছে।

এদিকে রিমান্ড শেষে চিত্রনায়িকা পরীমণিকে আজ আদালতে হাজির করা হতে পারে।

গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, চিত্রনায়িকা পরীমণি, মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌর বাসায় যাতায়াত ছিল এমন ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিদের কোনো তালিকা করা হচ্ছে না।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হেলেনা জাহাঙ্গীর, চিত্রনায়িকা পরীমণি, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, মাসুদুল ইসলাম ও শরফুল হাসান ওরফে মিশুর বিরুদ্ধে করা ১০টি মামলার তদন্ত করতে চায় র‌্যাব। তদন্তের অনুমতি চেয়ে পুলিশ সদর দফতরে চিঠি দিয়েছে র‌্যাব। রবিবার এই আবেদন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল কে এম আজাদ। সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, রবিবার রাতে পিয়াসা এবং নজরুল রাজের বারিধারা এবং বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে চারটি বিলাসবহুল গাড়ি আটক করেছে। অপর একটি সূত্র জানায়, আয়ের উৎস না থাকলেও বিলাসী জীবনযাপন করতেন পিয়াসা ও মৌ। তাদের আয়ের উৎস কী? গোয়েন্দাদের এমন প্রশ্নে কোনো জবাব ছিল না লেডি মাফিয়ার দুই গ্যাংস্টারের কাছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে সংঘটিত পুলিশ কর্মকর্তা মামুন খুনে নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে পিয়াসার কাছ থেকে। রিমান্ডে থাকা পিয়াসা তার ব্যবহারের বিলাসবহুল ফেরারি, বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিজ গাড়ি কিংবা বিলাসী জীবনযাপনের জন্য টাকার উৎসের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিলাসী জীবনযাপন ছিল মডেল পিয়াসা ও মৌর। নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনী, দেশি-বিদেশি দামি পোশাক, সেলফে সাজানো জুতাসহ বাহারি সব পণ্যের সমাহার ছিল তাদের। হাতে ৫০ লাখ টাকার রোলেক্স ঘড়ি। বাসার ভিতরে প্রবেশ করলে চোখ চড়কগাছ হওয়ার উপক্রম হয়। কারণ তাদের দৃশ্যমান আয়ের সঙ্গে জীবনযাপনের ব্যয়ের ছিল আকাশ-পাতাল ব্যবধান। গোয়েন্দারা এসব তদন্ত করতে গিয়ে তার পার্টনার নজরুল রাজ, মিশু হাসানের সঙ্গে অস্ত্র ও সোনা চোরাচালানের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। এ ছাড়াও তাদের এই সিন্ডিকেটে একজন ব্যবসায়ীর নাম বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে। এ ডায়মন্ড ব্যবসায়ীকে নিয়ে পিয়াসা নিজ বাসায় আসর বসাতেন। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে মডেল পিয়াসার ঘনিষ্ঠ ছবিও পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের রেকর্ড। এই ব্যবসায়ীর দেশে-বিদেশে রয়েছে শোরুম। এ ছাড়া দুবাইকেন্দ্রিক নারী পাচারের সঙ্গেও এদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বলে সূত্র জানায়।

তালিকা হচ্ছে না : ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, চিত্রনায়িকা পরীমণি, ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌর বাসায় যাতায়াত ছিল এমন ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিদের কোনো তালিকা করা হচ্ছে না। বরং এই তালিকার কথা বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হওয়া কথিত মডেলদের সঙ্গে সমাজের বিশিষ্টজনের নাম জড়িয়ে চাঁদাবাজি করছে একটি চক্র। গতকাল দুপুরে ডিএমপি সদর দফতরে নিজ কার্যালয়ে একাধিক দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) কৃষ্ণপদ রায় ও ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার ফারুক হোসেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, মডেল ইস্যুতে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিদের তালিকার কথা বলে একটি চক্র চাঁদাবাজিতে নেমেছে। চক্রটি সমাজের বিশিষ্টজনদের কাছে ফোনে তালিকার তাদের নাম থাকার কথা বলে চাঁদা দাবি করছে। এখন পর্যন্ত তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই ধরনের চাঁদাবাজির শিকার হওয়ার কথা পুলিশকে জানিয়েছে। তারা ফোনে জানিয়েছেন- তারা আতঙ্কিত। লোকলজ্জার ভয়ে গুলশানের আতঙ্কিত একজন ব্যবসায়ী পুলিশের সহযোগিতা কামনা করেন। এ ছাড়া একজন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চেয়ে চিঠি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। চাঁদা না দিলে গণমাধ্যমে পরীমণি, ফারিয়া মাহবুব ও মরিয়মের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা এসব চাঁদাবাজের বিষয়ে তথ্য দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। তিনি চাঁদাবাজদের কল রেকর্ড করতে ভুক্তভোগীদের পরামর্শ দেন। এসব কল রেকর্ড পরে পুলিশের কাছে জমা দিতে বলেন। পাশাপাশি এই চাঁদাবাজদের বিষয়ে স্থানীয় থানা বা ডিএমপিকে তথ্য জানানোর অনুরোধ জানান। ডিএমপি কমিশনার বলেন, কারও সঙ্গে সম্পর্ক থাকা তো বেআইনি নয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত এ বিষয়ে মামলা না হয়। চক্রটি কথিত ভিডিওর কথা তাদের বিশিষ্টজনদের ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশ এ ধরনের কোনো তালিকা করেনি। এমন তালিকার কথা বলে যারা বাণিজ্যে নেমেছে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে। আমরা চাই না করোনাকালে এমন আতঙ্ক ছড়াক এবং বিনা কারণে কারো সম্মানহানি হোক। কেউ যাতে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার না হন সে জন্য সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। যারা ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু আইনে মামলা হয়েছে। সেই মামলাগুলোই তদন্ত করছে পুলিশ।

১০ মামলার তদন্ত করতে চায় র‌্যাব : আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হেলেনা জাহাঙ্গীর, চিত্রনায়িকা পরীমণি, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, মাসুদুল ইসলাম ও শরফুল হাসান ওরফে মিশুর বিরুদ্ধে করা ১০টি মামলার তদন্তের আগ্রহ প্রকাশ করে পুলিশ সদর দফতরে চিঠি দিয়েছে র‌্যাব। রবিবার এ আবেদন করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল কে এম আজাদ।

তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের সঙ্গে যে কোনো চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করতে চায় র‌্যাব। অতীতেও এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক অভিযানেও অনেক সফলতা এসেছে এবং এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছে। এমন ১০টি মামলার তদন্ত করার অনুমতি চেয়ে পুলিশ সদর দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারণ এসব  ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্ত হলে দেশের নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত র‌্যাব ১ হাজার ৮০০টি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে আদালতে জমা দিয়েছে। আমরা যেসব অভিযান করেছি সেই মামলাগুলোর তদন্ত চেয়েছি। এদিকে গত ২৯ জুলাই গুলশানের বাসায় অভিযান চালিয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার বাসায় বিদেশি মদ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন আইনে পৃথক পাঁচটি মামলা করা হয়েছে।

এর দুই দিন পর ১ আগস্ট ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বারিধারা ও মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে মামলায়ও বাসা থেকে ইয়াবা ও মদ উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। পরে ৪ আগস্ট র‌্যাব বনানীর একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চিত্রনায়িকা পরীমণি, প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজকে গ্রেফতার করে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে পরীমণি ও নজরুলের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বনানী থানায় দুটি মামলা করা হয়। এরপর রাজধানীর ভাটারা এলাকা থেকে মাসুদুল ইসলাম জিসান ও শরফুল হাসান মিশুকে অস্ত্র, মাদক, অশ্লীল ভিডিওসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে মাসুদুল, শরফুল হাসান ও পিয়াসার বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় পৃথক চারটি মামলা করা হয়। থানা পুলিশ থেকে প্রথমে মামলাগুলোর তদন্তভার পেয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ। পরে পুলিশ সদর দফতর এসব মামলার তদন্ত করার জন্য পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দায়িত্ব দেয়।

সর্বশেষ খবর