শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু বললেন আমরা অসহযোগ আন্দোলন করব

ড. কামাল হোসেন

বঙ্গবন্ধু বললেন আমরা অসহযোগ আন্দোলন করব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে ছয় দফা বাস্তবায়ন অথবা এক দফা (স্বাধীনতা) দাবি করা হয়েছিল। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর ইসলামাবাদে গোলটেবিল বৈঠকে ছয় দফার দাবিও জানানো হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের আলোচনা চলতে থাকল। ছয় দফার বিষয়ে আমরা আপসহীন থাকলাম। ১৯৬৯ সালের মার্চে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে তিনি মার্শাল ল জারি করেন। আমরা ৫৬ ভাগ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দসহ সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব দিলে ইয়াহিয়া খান আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন পাচ্ছিলাম না। পরে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন দেওয়া হলো। নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে আমরা জয়লাভ করলাম। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পুরান ঢাকা ও তেজঁগাওয়ের দুটি আসন থেকে জয়লাভ করলেন।

পরে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন- ‘আমাকে তো একটি আসন ছাড়তে হবে। তুমি তেজগাঁও থেকে সংসদে আস।’ আমি উপনির্বাচন করলাম। বঙ্গবন্ধুর আসনের কারণে আমার বিপরীতে কেউ প্রার্থী হতে সাহস করল না। আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলাম। প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হলাম। কিন্তু নির্বাচনের পরও পশ্চিমা সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করল।

নির্বাচনের ফলাফল দেখে ভুট্টো আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। ভুট্টো আর সংসদীয় অধিবেশন ডাকেন না। এতে সংসদ সদস্যরা একত্রিত হয়ে ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে করণীয় সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলাম। অবশেষে ’৭১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি সভা ডাকা হয়। সেখানে ঘোষণা হলো ছয় দফার বাস্তবায়ন, অন্যথায় এক দফা (স্বাধীনতা)। অবশেষে চাপের মুখে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশনের ঘোষণা দিলেন। আমরা সংবিধান তৈরির চেষ্টা করলাম। এরই মধ্যে ২৯ ফেব্রুয়ারি গোপনসূত্রে জানতে পারলাম অধিবেশন মুলতবি করা হবে। পরে রেডিওতে ১ মার্চ বলা হয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন মুলতবি করা হলো। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বিকালে হোটেল পূর্বাণীতে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন- ‘আমরা অসহযোগ আন্দোলন করব। যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত।’ ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে পূর্ণদিবস হরতাল পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় তিনি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানানো হয়।

বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন, বিমান, জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক-বীমা অফিস-আদালত সবকিছুর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ল। অবস্থা দেখে মনে হয় যেন এ ধরনের ঘোষণার জন্যই অপেক্ষা করছে বাংলার মানুষ। সরকারি চাকরিজীবীরা রাস্তায় নেমে এলো। কিন্তু হাসপাতাল, খাদ্য গুদাম, থানা খোলা রাখা হলো। এ সময় একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হলো। অতিরিক্ত সচিব সানাউল হকের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিজীবীরা এসে ঘোষণা দিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকারি অফিস-আদালত চলবে। এদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশে আসেন। সর্বক্ষণ খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। অবশেষে ৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশ্বাসের পাশাপাশি ঘোষণা করলেন ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে। ৬ মার্চ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও আমাকে ৭ মার্চ ভাষণের খসড়া তৈরির নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় আমার বন্ধু এম আমীর-উল ইসলামও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন- ‘এমনভাবে ভাষণ দিতে হবে যেন আর্মিরা সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ না চালায়।’ আমরা যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করি তাহলে আর্মিরা হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে। এরই মধ্যে ৭ মার্চ দুপুরের পর শুরু হলো বক্তব্য। এ সময় হাই কোর্টের প্রাঙ্গণে, বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদের ওপর পাক আর্মিরা মেশিনগান তাক করে বসে আছে। যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয় তাহলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমনভাবে কৌশলে বক্তব্য দিলেন সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল এবং এ এলাকার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে চলে এলো। এ অবস্থায় পশ্চিমারা পাগল হয়ে ওঠে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা সাংবাদিকরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- এর সমাধান কী? আমি উত্তরে বললাম, দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো স্বাভাবিক অর্থাৎ ছয় দফা মেনে নেওয়া, অন্যটি অস্বাভাবিক পথ অর্থাৎ যুদ্ধ। তবে মনে হচ্ছে পাক বাহিনী অস্বাভাবিক পথ বেছে নিচ্ছে। এদিকে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। তাঁর কাছে সংবিধানের খসড়া পেশ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান নীরব থাকেন এবং সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন শুরু করে। এ ছাড়া আমরা জানতে পারলাম জাহাজে ও বিমানে করে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনারা অবতরণ করছে। দেখতে দেখতে ২৫ মার্চ এসে গেল। সারা দেশে যেন একটা আতঙ্কের ছাপ। মানুষ বুঝতে পারছে দেশে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। অবশেষে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু দলের নেতা-কর্মীদের আত্মগোপনে চলে যেতে বললেন। আমি এবং আমীর-উল ইসলাম একত্রে তাজউদ্দীনের ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের বাসায় গিয়ে তাঁর বাড়িতে উঠলাম। রাত ৮টার দিকে আমরা যখন সাত মসজিদ রোডের দিকে যাচ্ছিলাম তখনই খবর পাই রাস্তায় রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গাছ কেটে ব্যারিকেড বসিয়েছে। এ সময় মোজাফফর নামে কুমিল্লার এক সংসদ সদস্য আমাদের জানান যে নিউমার্কেটের সামনে ইপিআর অবস্থান নিয়েছে। ফলে পুরান ঢাকায় না গিয়ে আপাতত ধানমন্ডির আশপাশে আত্মগোপনের উদ্যোগ নিলাম। এ সময় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে যাই। রাত ৯টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যাওয়ার পর দেখলাম বঙ্গবন্ধু রাতের খাবার খাচ্ছেন। আমরা গিয়ে তাঁকে আত্মগোপনের কথা বললে তিনি অস্বীকার করেন। একই সঙ্গে আমাদের দ্রুত আত্মগোপনে যেতে বলেন। আমরা লালমাটিয়ার কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি তাজউদ্দীন ভাইকে বললাম, আমরা সবাই একসঙ্গে থাকা ঠিক হবে না। রাতের পরিস্থিতি বুঝে আলাদাভাবে থাকার পর সকালে নদী পার হয়ে ঢাকা থেকে বের হয়ে যাব। অবশেষে তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলামকে বিদায় দিয়ে আমি লালমাটিয়ায় এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলাম। পরদিন আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা আমাকে ছেড়ে চলে যান। চার দিন বাড়ি পরিবর্তন করে থাকার পর লালমাটিয়ার একটি বাসা থেকে ৩০ মার্চ আমাকে আটক করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি আর্মিরা। সন্ধ্যার সময় আমাকে আটক করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি গেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক আর্মি অফিসার আমাকে বলেন- ‘তোমার নেতাকেও এই জায়গায় রাখা হয়েছিল। তুমিও এখানে থাক।’ অনুলিখন : মাহমুদ আজহার

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর