শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

শোক এখন শক্তির অনির্বাণ উৎস

মোনায়েম সরকার

শোক এখন শক্তির অনির্বাণ উৎস

বঙ্গমৃত্তিকায় যেসব মহান পুরুষ জন্ম নিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান শেখ মুজিব। তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা। তাঁর দূরদর্শী ও ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে একটি পরাধীন জাতি পায় স্বাধীনতার স্বাদ। বহু বছরের শোষণ-দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে তিনি গড়ে তোলেন সমৃদ্ধিশালী, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। একটি অবহেলিত ভূখন্ডের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা অর্জনের মতো নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিরল নেতা। যে মানুষটি কখনই বাঙালিকে অবিশ্বাস করেননি, শত্রু ভাবেননি, সেই শুদ্ধ চিত্তের মানুষটিকেই কতিপয় স্বার্থপর-ঘাতক বাঙালি সপরিবারে হত্যা করল; যা শুধু বাঙালির ইতিহাসেই  নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি কলঙ্কজনক ঘটনা বলে বিবেচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড শুধু একটি হত্যাকান্ডই নয়, একটি স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক জাতিকে পরাধীন ও সাম্প্রদায়িক করার পাশবিক চক্রান্তও বটে। আমরা যদি মুজিব হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রগুলো বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব একটি স্বাধীন জাতিকে মূলত তারাই ধ্বংস করতে চায় যারা সাম্রাজ্যবাদের পূজারি বা সাম্রাজ্যবাদের মদদদাতা। সুতরাং যারা সাম্রাজ্যবাদী এবং যারা সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক তারাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারী থেকে হত্যাকান্ড বাস্তবায়নকারী সবাই অপরাধী, সবাই মুজিব-হন্তারক।

শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পর সমগ্র বাংলাদেশ থমকে গিয়েছিল। বজ্রাহত মানুষের মতো অসাড় হয়ে গিয়েছিল বাংলার শোকাহত মানুষ। ঘনিষ্ঠ স্বজন মারা গেলে মানুষ যেমন বাকরুদ্ধ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, শেখ মুজিব হত্যার ঘটনায়ও পুরো বাঙালি জাতি শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে গিয়েছিল। মানুষ এখন সেই অবশ মুহূর্তগুলোর কথা ভুলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করছে, তাঁর নামে স্তুতি-স্তব করছে, এটাই এখন ইতিহাস।

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। এদিন কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিব নিহত হননি। আবার কেবল ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি বা ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়, এর সঙ্গে জড়িত ছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা। এ চক্র এখনো সক্রিয় রয়েছে। তা আমরা প্রতিনিয়তই বুঝতে পারছি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগের দিন ঢাকা শহরে বাস-ট্রাকে আগুন, ব্যাপক ভাঙচুর ও নাশকতামূলক তৎপরতায় মানুষের মনে সে কথাই ধ্বনিত হয়েছে। বিএনপি যে আবরণেই তার তৎপরতা চালাক না কেন, জনগণ ঠিকই তাদের নাশকতামূলক তৎপরতা ধরে ফেলেছে। এ কাজ করে তারা তাদের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নিয়ে গেছে।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয় এবং তাঁর হত্যাকান্ড যেমন ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়েছিল আমাদের, তেমনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনকের হত্যাকান্ডে আমরা পিছিয়ে যাই এবং দেশ আবার উল্টোমুখে ফিরে যায় পাকিস্তানি ধারায়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর স্বাধীনতার ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের হত্যা এবং আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর ওপর নির্মম দমননীতির মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষশক্তিকে দুর্বল করে ফেলা হয়। শেখ হাসিনার দূরদর্শী, সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্রুত পুনর্গঠিত হয়। জনগণ ফিরে পায় ভোটাধিকার। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এ অধিকার প্রয়োগ করে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে আওয়ামী লীগকে। পাকিস্তানি ধারার পরিবর্তে দেশ পুনরায় এগিয়ে চলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারায়। অর্থনীতি ফিরে পায় গতিশীলতা। তলাবিহীন ঝুড়ি আর ভিখারির দেশের অপবাদ ঘুচিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল।

বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। শত্রু-মিত্র চিনতে হবে তাঁকে। কেউ যেন বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে সুবিধা আদায় না করতে পারে এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি সম্মানার্থে কর্মীদের উচিত তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো নিপুণভাবে সম্পন্ন করা। দেশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কাঁধে পড়েছে। এ দেশকে একবিংশ শতাব্দীর যোগ্য করে গড়ে তুলে ধরতে হবে। বঙ্গবন্ধু আজ বিশ্ববন্ধু হয়ে উঠেছেন। তাঁর নামে ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন তিনি। শান্তিকামী বঙ্গবন্ধু শান্তির সপক্ষে লড়াই করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, বঙ্গবন্ধুর নামে ইউনেস্কো-ঘোষিত শান্তি পদক বাঙালি জাতিকে নতুন গৌরব দান করেছে। সারা বিশ্বেই এখন মহাসমারোহে উদ্যাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। করোনা মহামারীর কারণে আনুষ্ঠানিকতায় কিছুটা ধীরগতি এলেও মানুষের অন্তরে বঙ্গবন্ধু আজ অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। ১৫ আগস্ট বাঙালির জন্য এখন শুধু আর শোকের মুহূর্ত নয়, শোক এখন পরিণত হয়েছে শক্তির অনির্বাণ উৎসবিন্দুতে। নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। জাতীয় শোক দিবসে পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির শহীদদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সর্বশেষ খবর