রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

ইভ্যালি কোন পথে যাচ্ছে

গ্রাহকের স্বার্থে সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পেনশনের টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা তুলে ইভ্যালির সাইক্লোন অফারে ২০টি বাইক অর্ডার করেছিলেন। গত জুলাইয়ে এই অফারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো বাইকগুলো বুঝে পাননি ওই কর্মকর্তা। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তার ইনভয়েসের কাগজপত্র দিয়ে অনুরোধ করছেন, বাইকের দরকার নেই, তাঁকে যেন আসল টাকাটা তুলে দেওয়া হয়। জানা গেছে, ওই কর্মকর্তার একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেটি ছিল বেকার। করোনা মহামারীর সময় যখন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ তখন দেদার চলছিল ইভ্যালির সাইক্লোন অফার, যেখানে একটি বাইকে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হচ্ছিল। কর্মকর্তার ভাবনা ছিল, অফারের বাইকগুলো নিয়ে বাইরে বিক্রি করে কিছু বাড়তি আয় করবেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারীতে আয়ের আশায় অকল্পনীয় অফারের লোভে পড়ে এভাবেই হাজার হাজার ভোক্তা ইভ্যালিতে অর্ডার করেছেন। অনেকে সঞ্চয়ের টাকা, গৃহিণীর জমা অর্থ, এমন কি পেনশনের টাকা দিয়েও অর্ডার করেছেন। লোভনীয় অফারের ফাঁদ তৈরি করায়, প্রয়োজন নেই এমন পণ্যও অর্ডার করেছেন হাজার হাজার ভোক্তা। গ্রাহকের জন্য লোভের ফাঁদ তৈরি করে পণ্য কিনতে বাধ্য করার এই প্রক্রিয়াটিকেই এখন ডিজিটাল প্রতারণা হিসেবে দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর এই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কী পরিমাণ ভোক্তা পণ্যের অর্ডার করেছেন, আর সেই পণ্যই বা কীভাবে সরবরাহ করা হবে-এখন সেই পরিকল্পনাই জানতে চাইছে সরকার।

কী পরিমাণ পণ্যের অর্ডার ইভ্যালিও জানে না : ইভ্যালি থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ পণ্যের অর্ডার দেওয়া হয়েছে, তাতে জড়িত টাকার পরিমাণ কত- এটিই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর না জানে বাংলাদেশ ব্যাংক, না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, না আছে দুদকের কাছে। এমন কি খোদ ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও এই বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। গত ১৯ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইভ্যালিকে কারণ দর্শানো নোটিসে এসব তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি পাঠানোর পর প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোহাম্মদ রাসেল ওই চিঠির জবাবে তথ্য দিতে ছয় মাস সময় দাবি করে বলেছেন, প্রায় ৫ হাজারের বেশি মার্চেন্টের সঙ্গে তাদের হিসাব আছে। ডেলিভারিকৃত পণ্য গ্রাহক কর্তৃক পাওয়ার নিশ্চয়তার প্রমাণ, ত্রুটিপূর্ণ পণ্যের অভিযোগ, পূর্ববর্তী বিলের সমন্বয় করে মার্চেন্টের পূর্ণাঙ্গ হিসাব সম্পন্ন করার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। একটি তৃতীয় নিরপেক্ষ নিরীক্ষক দ্বারা সম্পূর্ণ আর্থিক হিসাব বিবরণী তৈরির পর ইভ্যালি সরকারকে তাদের লেনদেনের হিসাব জানাতে পারবে বলে জানিয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, ইভ্যালির অর্ডার, লেনদেনের তথ্য দেওয়ার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংককেও সহায়তা করেনি। গত ১৪ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল ইভ্যালির কার্যালয়ে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য চাইলেও তারা তা দিতে সমর্থ হয়নি। এ সময়  প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ইভ্যালি রেপ্লিকা ডাটাবেজ অনুসন্ধানের সুযোগ চাইলেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্চভিত্তিক প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা প্রতিষ্ঠানটির কাছে ১৫ জুলাইভিত্তিক লেনদেনের হিসাব জানতে চেয়েছি। ইভ্যালি জুলাই থেকে তাদের সাইক্লোন অফারটি বন্ধ করে দেয়। ফলে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেনদেন ও অর্ডারের তথ্য পেলে প্রতিষ্ঠানটির লাভ-লোকসান এবং পণ্য সরবরাহের সক্ষমতাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ব্যাপারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া স্ট্যাটাসগুলো থেকেও পণ্যের অর্ডার সম্পর্কে আনুমানিক ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে এ ধরনের ধারণা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।

সূত্র জানায়, ইভ্যালি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর গত ১০ জুলাই ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল একটি স্ট্যটাস দেন- যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, টি-টেন ক্যাম্পেইন শুরুর পর এক দিনে তার প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২০০ কোটি টাকার অর্ডার পেয়েছেন।

সরকারের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রাসেলের এই তথ্য সত্য ধরে নেওয়া হলে, সাইক্লোনে দেওয়া অর্ডারের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী ছয় মাস সময়ের মধ্যে বকেয়া এসব অর্ডার সরবরাহ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ এরই মধ্যে বিশ্বস্ততায় ঘাটতির কারণে অনেক মার্চেন্ট প্রতিষ্ঠানটিকে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।

লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে কি ইভ্যালি : সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একদিকে যেমন ইভ্যালির দায়-দেনা নিয়ে তদন্ত করছে, তেমনি প্রতিষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি-না সেই বিষয়টিও পর্যালোচনা করছেন। গত ১ জুলাই ইভ্যালির এমডি ঘোষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অফার ‘সাইক্লোন’ বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে টি-১০ এবং টি-সেভেন নামে দুটি অফার দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সাইক্লোন অফার চলাকালীন গত ১৪ মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, সে অনুযায়ী কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৬ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা শুরুর পর প্রথম বছর লোকসান ছিল মাত্র ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। এরপর প্রতিষ্ঠানটি যখন একটি পণ্যের বিপরীতে একটি ফ্রি, সাইক্লোন নামে বিভিন্ন ধরনের আগ্রাসী কার্যক্রম শুরু করে তখন ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলে যত অর্ডার বেড়েছে, তত বেড়েছে লোকসান। মার্চের ৩০০ কোটি টাকার লোকসানটিকে নিট ক্ষতি ধরলেও বর্তমানে যে রীতিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলছে তাতে ওই লোকসান কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইভ্যালি লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি-না এ বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। যদি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে এগিয়ে আসে সেক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি হতে পারে। আমরা জেনেছি, যমুনা গ্রুপ প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগের চুক্তি করেছে। তবে এই বিনিয়োগ নগদ অর্থ না-কি পণ্য সরবরাহ করে হবে- সে বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট করেনি ইভ্যালি।

কার্যালয় বন্ধ রেখে এখনো চলছে কৌশলী খেলা : ইভ্যালির কাছে গ্রাহক শুধুমাত্র পণ্য পায় তাই নয়, পণ্য দিতে পারেনি বলে যাদের রিফান্ড করার জন্য ব্যাংকের চেক দেওয়া হয়েছে, সে অর্থও বকেয়া রয়ে গেছে। গ্রাহকেরা বন্ধ কার্যালয়ের সামনে গত সপ্তাহেও পণ্য ও রিফান্ডের অর্থ পেতে মানববন্ধন করেছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে গ্রাহকের ক্ষোভ সামলাতে না পেরে পণ্য ডেলিভারির ধানমন্ডির কার্যালয়টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল লকডাউনের কারণে সাময়িকভাবে অফিসটি বন্ধ রয়েছে। এখন লকডাউন ওঠে গেলেও কার্যালয় খোলা হয়নি। ১১ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য সরবরাহের সময় দিয়ে নোটিস দেওয়ার জন্য পত্রবাহক গিয়ে ইভ্যালির অফিস বন্ধ দেখতে পায়। এরপর লেটারবক্সে চিঠি রেখে আসেন। ই-মেইলেও চিঠির কপি পৌঁছানো হয়। তবে অফিস বন্ধ থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির প্রতারণার কৌশল থেমে নেই বলে গ্রাহকদের অভিযোগ থেকে জানা গেছে। ক্রেতারা জানান, গত কয়েক দিন ধরে ইভ্যালির কর্মকর্তারা কাস্টমারদের মোবাইল ফোনে কল করে তাদের নামে ইস্যু হওয়া চেক ছিঁড়ে- তার স্পষ্ট ভিডিও পাঠাতে বলছেন। বলা হচ্ছে, যারা চেক ছিঁড়ে পাঠাবেন তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাওনা টাকা জমা হবে। যারা চেক ছিঁড়ে পাঠাবে না, তাদের টাকা নিয়ে জটিলতা হবে। সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি স্বীকারও করেছেন ইভ্যালির এমডি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এই অভিযোগটি শুনেছেন এবং বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। যেহেতু ব্যাংকের চেক বাউন্স হলে এ বিষয়ে পরোয়ানাযোগ্য মামলা করা যায়; সে কারণে এসব ডকুমেন্ট নষ্ট করে দেওয়ার কৌশল হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

ব্র্যান্ডভ্যালু দিয়ে পার পাওয়ার কৌশল : লেনদেনের হিসাবসহ প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস প্ল্যান জানানোর জন্য তিন সপ্তাহ সময় দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ১৯ আগস্টের মধ্যে তাদের লেনদেনের হিসাব ও সম্পদের তথ্য দিতে হবে। পরবর্তী দুই সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটির পণ্যের অর্ডার ও বিজনেস প্ল্যানসহ অন্যান্য তথ্যগুলো দিতে হবে। ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল নিজেও কৌশল সাজাচ্ছেন কীভাবে তিনি কোম্পানিটিকে টিকিয়ে রাখবেন। গত ৩১ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে তিনি তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বলেছেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে বকেয়া সব পণ্যের ডেলিভারি পৌঁছে দেবেন। এর আগ পর্যন্ত ১৫ দিন পরপর পণ্য ডেলিভারির আপডেট জানাবেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। সাইক্লোন অফার বন্ধ করে দেওয়ার পর এখন টি-টেন ও টি-সেভেন নামক ক্যাম্পেইন দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে চাইছেন, যেখানে ১০ শতাংশ অগ্রিম দিয়ে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারির নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে বকেয়া ডেলিভারি সরবরাহ না হওয়ায় এসব ক্যাম্পেইনে সারা মিলছে না। গ্রাহকদের আস্থা আনতে সম্প্রতি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়ে আবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। আবেদনে বলেছেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক বা মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান এ তিন পক্ষের মধ্যে চুক্তিটি হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের চুক্তির আবেদন করে গ্রাহকদের মধ্যে ইভ্যালি সম্পর্কে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে সেটি দূর করতে চাইছেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের মতে এটিও ছিল এক ধরনের কৌশল। কারণ, ইভ্যালির এমডি যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির কথা বলেছেন, এ বিষয়ে সরকার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পণ্য পাওয়ার আগ পর্যন্ত তৃতীয় পক্ষের (আর্থিক প্রতিষ্ঠান) কাছে অর্থ আটকে থাকবে। অর্ডার কনফার্ম হওয়ার পরই কেবল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে টাকা ছাড় হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভ্যালির কাছে কোনো আলাদিনের চেরাগ নাই যা দিয়ে তিনি তার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবেন বা গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকার পণ্য ডেলিভারি দিতে পারবেন। তার কাছে যেটি আছে সেটি শুধু ব্র্যান্ডভ্যালু। আর এই ব্র্যান্ডভ্যালুকেই পুঁজি করে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখার কৌশল সাজাচ্ছেন। কিন্তু ভোক্তাদের কাছে প্রতারণার কৌশল ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর এখন এই ব্র্যান্ডভ্যালু কতটা আছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে দুদক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তও চলছে। এসব তদন্তে কী বেরিয়ে আসে সেটিও প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তদন্তের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও ইভ্যালি বিষয় আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির প্রধান মো. হাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গ্রাহকের স্বার্থরক্ষায় আমরা ইভ্যালির বিষয়ে জিরোটলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, তাদের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। অধিদফতরের কাছে ইভ্যালির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ৬ হাজারের ওপরে। এগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে। এই কর্মকর্তা জানান, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে মামলায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তির পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু দিনের পর দিন যদি অভিযোগ আসতে থাকে, আর তা নিষ্পত্তি না হয়, তবে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে অধিদফতর।

দুষ্টুচক্রে বাঁধা ইভ্যালি কোনপথে যাবে : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ইভ্যালির মোট দায় ৪০৭ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়েছে ২১৪ কোটি টাকা, আর মার্চেন্টদের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য নিয়েছে ১৯০ কোটি টাকার। স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিষ্ঠানটির কাছে কমপক্ষে ৪০৪ কোটি টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা। কিন্তু সম্পদ আছে মাত্র ৬৫ কোটি টাকার। এই হিসাবটি ছিল ১৪ মার্চ পর্যন্ত। জুলাই পর্যন্ত সাইক্লোন অফার চলায় এই দায় ও লোকসান আরও ভারী হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে বলেছে, কোম্পানিটি চলতি দায় ও লোকসানের দুষ্টচক্রে বাঁধা পড়েছে, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির টিকে থাকা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

ইভ্যালি যে ঝুঁকিতে আছে সেটি তার গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়া থেকেও বোঝা যাচ্ছে। তিন মাস আগেও ইভ্যালির ওয়েবসাইটে সাইক্লোন অফারের নোটিস দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন ক্রেতারা। লাইক কমেন্ট পড়ত হাজার হাজার, যেটিকে প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ডভ্যালু হিসেবে তুলে ধরে বিভিন্ন মার্চেন্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাকিতে পণ্য নিত ইভ্যালি। গতকাল প্রতিবেদন লেখার সময় প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা গেছে সর্বশেষ পণ্যের নোটিসটি ২১ ঘণ্টা আগের। আর তাতে সর্বসাকুল্যে লাইকের সংখ্যা ৪০০। কমেন্টের সংখ্যা দেড় হাজার পার হলেও এসব কমেন্টে প্রতিষ্ঠানটির কাছে পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ আর ইভ্যালিকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হওয়ার হাহাকার নিয়ে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে। সৈয়দ শাহ মোস্তফা তোহা নামে এক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, ‘সবাই যখন গালাগালি করেছে আপনাদের, আমি তখন বলেছি ইভ্যালি টিকে থাকবে শেষ দিন অবধি, কারণ অনেকের স্বপ্ন আপনারা পূরণ করেছেন; কিন্তু এখন ভাবতেছি ভুল বলেছিলাম। লাস্ট ৪-৫ মাস আমার প্রোডাক্টগুলো নিয়ে যে কাহিনি করেছেন, আফসোস হয় আপনাদের বিশ্বাস করে।’

গ্রাহকের এত ক্ষোভ আর এত অবিশ্বাস নিয়ে কোন জাদুবলে, কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি তার উত্তর পাওয়া যায়নি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে। ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেলকে একাধিকবার ফোন দেওয়া  (মোবাইল নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপে) হলেও তিনি ধরেননি। মেসেজ পাঠানো হলেও দেননি উত্তর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর