শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসাদের দুঃসহ স্মৃতি

রফিকুল ইসলাম রনি

‘নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা) বক্তব্য শেষ করলেন, আমি মাকে ডাকব, এমন প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ সময় প্রচ- বিস্ফোরণ। প্রচ- শব্দে কানে তালা লেগে গেছে। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি রক্তে ভিজে যাচ্ছে। আহত-নিহত অনেকে পড়ে আছেন। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম। এরপর কী হয়েছে জানি না।’ ঠিক এভাবেই গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে সেই ভয়াল  একুশে আগস্টের দুঃসহ স্মৃতি বলছিলেন মাদারীপুরের পাঁচখোলা গ্রামের সম্রাট আকবর সবুজ। সবুজ আরও বলেন, ‘ঘটনার পরের দিন বুঝতে পারি আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু পুলিশ আমাকে চিকিৎসা নিতে দেয়নি। বাধ্য হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আসি। সেখানেও একই পরিস্থিতি। অন্ডকোষ ও শরীরে এখনো অসংখ্য স্পিøন্টার। ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই পুরো ঘটনা ভেসে ওঠে।’ আজ থেকে ১৭ বছর আগে সবুজ ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে মায়ের সঙ্গে যোগ দেন আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ শান্তির শোভাযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে। সেদিন তাঁর সঙ্গে মা মনোয়ারা বেগমও আহত হন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের আউটসোর্সিংয়ে চাকরি করতেন সবুজ। প্রকল্প শেষ হওয়ায় চাকরিটা চলে যায়। তিনি জানালেন, নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, চাকরির জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিনি। প্রধানমন্ত্রী একটা চাকরি দেওয়ার জন্য তৎকালীন কর্মকর্তাদের নির্দেশও দেন। কিন্তু এখনো হয়নি। কী যে মানবেতর জীবন পার করছি-ভাষায় বোঝাতে পারব না... বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সেদিনের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশ ডেকেছিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। সমাবেশের সভাপতি ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ আর সমাবেশ সঞ্চালনা করেছিলেন যৌথভাবে সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। দেহে স্পিøন্টার নিয়ে ভুগতে ভুগতে হানিফ চিরবিদায় নেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, সারা বাংলাদেশে সিরিজ বোমা হামলা, সমাবেশে হামলা, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে মানুষ দিশাহারা। তারই প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মহানগর আওয়ামী লীগকে নির্দেশ দেন সমাবেশ ও মিছিল করার জন্য। আমরা মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করার জন্য সিটি করপোরেশন, পুলিশ কমিশনার, ডিসি অফিসে আবেদন দিই। কিন্তু ২০ তারিখ পর্যন্ত কোনো উত্তর দেয়নি। তখন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিই। সাবেক মন্ত্রী মায়া বলেন, ‘মিটিংয়ের শেষের দিকে নেত্রী এসে বক্তব্য শেষ করলেন, ঠিক এমন সময় সাংবাদিক গোর্কিসহ কয়েকজন বলল আমরা ছবি পাইনি। পরে একটু ঘুরে এসে আমার হাত থেকে মাইকটা নিয়ে নেত্রী আবার এক মিনিটের মতো মাইকের সামনে ছিলেন। নেত্রী ঘুরে নামার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছিলেন, এমন সময় বিকট শব্দ। আমরা ভাবছিলাম হয়তো ট্রাকের চাকা ব্লাস্ট হয়েছে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আরেকটা ব্লাস্ট হইছে। এরপর একটা বিকট শব্দ আর চারদিকে ধোঁয়া, চিৎকার। তখন আপাকে (শেখ হাসিনা) ধরে আমি আর হানিফ ভাই টেবিলের নিচে দিয়ে আমরা কয়েকজন ওপরে পড়ে থাকি। তখন ট্রাকের অনেকেই যে যেভাবে পারছে নিচে নেমে গেছে। যখন দেখলাম বন্ধ হইছে তখন আপাকে ধরে ট্রাক থেকে নামিয়ে গাড়িতে নিয়ে যাই। আপা তখন বলেন, ‘তোরা আমারে কই নিয়া যাস, আমার নেতা-কর্মীরা এখানে পইড়া আছে’। আমি বলেছি আপা আপনাকে আগে নিয়া যাই পরে দেখি কী হচ্ছে। এর মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে থেকে সমানে গুলি শুরু হইছে। এরপর আপাকে সুধা সদনে রাখি। আপা বললেন, ‘জাহাঙ্গীর (শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী), মায়া তোরা দেখ পার্টি অফিসে কী হইতাছে’। আমরা গাড়ি নিয়ে ঢাকা ক্লাবের সামনে পর্যন্ত আসতে পারছি, এরপর আর আসতে দেয় না। তখন দৌড়াইয়া পার্টি অফিসে আসি। আইসা দেখি আরেক কান্ড, মানুষের রক্ত চারদিকে, চিৎকার। আর পুলিশ শুরু করেছে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ। এর মধ্যেই যে যেভাবে পারছে আহত নেতা-কর্মীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেছে। সেই স্মৃতি মনে পড়লে আজও আঁতকে উঠি।’ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বলেন, ‘নেত্রী বক্তৃতা শেষ করলেন। জয় বাংলা বলে জয় বঙ্গবন্ধু বলারও সুযোগ পেলেন না। ট্রাকের ডালাটা হাতে ধরা আছে। দেখলাম, দুই হাতে কান ঢেকে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আমি চিৎকার করে বলার চেষ্টা করছিলাম, নেত্রীকে বাঁচাও। হানিফ ভাই, মায়া ভাইসহ সিনিয়র নেতারা সেদিন মানবঢাল করে নেত্রীকে ট্রাক থেকে নামিয়ে নিয়ে যান। সেদিনের কথা ভোলার নয়।’ ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরদিন পত্রিকায় মৃতদের ছবির সঙ্গে ছাপা হয়েছিল সাভারের মাহবুবা আকতারের ছবি। তিনি ছিলেন মৃতদের তালিকায়। সেই দিনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে মাহবুবা বলেন, শরীরে দেড় হাজার স্পিøন্টার। রাতে এক ঘণ্টা ঘুম হয়। বাকি সময়টা এপাশ-ওপাশ করেই কাটাই। চোখ বুজলেই এখনো শুনতে পাই সেই ভয়াবহ নারকীয় গ্রেনেডের শব্দ।  আওয়ামী লীগের শান্তির সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবক লীগের দায়িত্বে ছিল সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সংগঠনটির তৎকালীন সভাপতি বর্তমানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গুরুতর আহত হন। তিনি বলেন, ‘আমি তিন দিন আইসিইউতে ছিলাম, তিন দিন পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম।

 

সর্বশেষ খবর