সোমবার, ২৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর ষড়যন্ত্রে নেমেছেন মাহফুজ আনামরা

হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে তৎপর মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর ষড়যন্ত্রে নেমেছেন মাহফুজ আনামরা

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে গতকাল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নেতারা ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর ষড়যন্ত্রে নেমেছেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও তার স্ত্রী মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তারা সনাতন ধর্মে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা শাস্ত্রীয় বিধানগুলো পরিবর্তনের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। এতে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে ও দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নেতারা এসব মন্তব্য করেন। তারা বলেন, ‘সনাতন ধর্মে হাত দেওয়ার অধিকার কারও নেই। আমরাও অন্য ধর্মে হাত দিতে চাই না। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের সনাতন ধর্মে হাত দেওয়ার অধিকার মাহফুজ-শাহীন চক্রের নেই। সনাতন ধর্মের অনুসারী তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার বছরের ঐক্য এবং ঐতিহ্যকে বিলীন করার অপচেষ্টা নিয়ে হিন্দুদের ঘরে ঘরে অশান্তির বীজ বপন করছে বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ‘বাঁচতে শেখা’-এর পরিচালক অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। তারা এ জন্য বিদেশ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে এসেছেন। যার বড় অংশ নিজেরা আত্মসাৎ করেছেন এবং কিছু টাকা ব্যয় করে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রতিপক্ষ বানানোর অপচেষ্টা করছেন। যাতে দেশে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। এতে সরকারবিরোধী এই চক্র নানা দিক থেকে সুবিধা ভোগ করবে। বিষয়টি বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করার ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, আগামী ৩০ আগস্টের মধ্যে মাহফুজ আনাম ও শাহীন আনামকে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’

বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি অ্যাডভোকেট বিধান বিহারী গোস্বামীর সভাপতিত্বে ‘হিন্দু ধর্মীয় আইন পরিবর্তন প্রচেষ্টার প্রতিবাদে হিন্দু সম্প্রদায়ের সব ধর্মীয় সংগঠনের সমন্বয়’-এ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে অ্যাডভোকেট বিধান বিহারী গোস্বামী বলেন, ‘হিন্দু আইনের কোনো পরিবর্তন সরকার চাচ্ছে না। কতিপয় এনজিও চাচ্ছে তাদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা। আমাদের সমস্ত সুরক্ষা তিনিই দেবেন।’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট প্রতিভা বাগচী। তিনি বলেন, ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি এনজিও হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা সুসংহত পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে অশান্তির বীজ বপন করছে। ২০-২৫ হাজার বছরের পুরনো হিন্দু পরিবার ব্যবস্থা ধ্বংস করে বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন তারা। তাদের দুরভিসন্ধি হাসিলে হিন্দু আইন সংস্কারের জন্য আইন কমিশনে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। যার নেতৃত্বে আছেন শাহীন আনাম ও তার স্বামী মাহফুজ আনাম।’

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ‘আইন সংস্কারের নামে মন্দির ভেঙে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর ষড়যন্ত্রে নেমেছে এই চক্র। তাদের সঙ্গে রয়েছে ‘বাঁচতে শেখা’র পরিচালক অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। তাদের নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনার করে হিন্দু বিধিবিধান সম্পর্কে মিথ্যা, অসত্য, কাল্পনিক ও বিদ্বেষমূলক বিকৃত তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে সারা দেশের হিন্দু সমাজের মধ্যে ভয়ানক অস্থিরতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে এই চক্রটি।’

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ‘হিন্দু পারিবারিক সম্পত্তি বিভাজন করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পত্তি বণ্টন, বিবাহ বিচ্ছেদ, হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক ও শাস্তির বিধান, দত্তক, ভরণ-পোষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রীয় পবিত্র বিধি পরিবর্তনের চক্রান্ত করছে। এটা বাস্তবায়ন হলে হিন্দু ধর্মের অনুসারী বহু নারীকে সন্তান নিয়ে রাস্তায় থাকতে হবে। তাদের সংসার ভেঙে যাবে। বহু সন্তান পিতাহারা হবে। যা সমাজে ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি করবে। যার দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। কারণ ভারতে হিন্দু নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের আইন করায় বহু নারীর ঘর ভেঙেছে। তাদের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাধ্য হয়ে তারা তাদের পুনর্বাসন করছে।’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আগামী ৩০ আগস্টের মধ্যে শাহীন আনাম গংদের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে শর্তহীন ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়। একই সময়ে হিন্দু আইনে কোনো ধরনের হাত দেওয়া হবে না- সরকারকে এমন ঘোষণা দেওয়া এবং শাহীন আনাম গংদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। এসব দাবি না মানা হলে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ অফিস ঘেরাও কর্মসূচির কথা বলা হয়।

প্রণব মঠ ঢাকার অধ্যক্ষ স্বামী সঙ্গীতানন্দ মহারাজ বলেন, ‘মাহফুজ আনাম ও শাহীন আনাম গংরা চাইছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ এটা প্রমাণ করতে। তারা আইন সংস্কারের নামে চক্রান্তে নেমেছেন। বাস্তবতা হলো সনাতন ধর্মে অন্য ধর্মের কারও হাত দেওয়ার অধিকার নেই। আমরাও অন্য ধর্মে হাত দিতে চাই না। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের সনাতন ধর্মে হাত দেওয়ার অধিকার মাহফুজ আনামদের নেই। হাজার হাজার বছর আমাদের হিন্দু ধর্ম নিজস্ব নিয়মকানুন মেনে সনাতন পদ্ধতিতে চলে আসছে। মাহফুজ আনামরা আমাদের ধর্মে নারীর অধিকারের কথা বললেও বাস্তবতা হলো এ ধর্মে কারও অধিকার কখনো খর্ব হয়নি। তারা সনাতন ধর্মের আইনের অপব্যাখ্যা করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। এ দেশে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। তারা সরকার ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে চাচ্ছেন। কোনো ধরনের সংস্কার আমাদের দরকার নেই।’

মহাজোটের যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট লাকী বাছার বলেন, ‘আইন পরিবর্তনের নামে হিন্দু মা-বোনদের বলির পাঁঠা বানাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ কুচক্রী মহল। এর নেতৃত্বে রয়েছেন শাহীন আনাম, তার স্বামী মাহফুজ আনাম এবং অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। তারা হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন।’ লাকী বাছার আরও বলেন, ‘হিন্দু মা-বোনেরা চায় না এ আইন পরিবর্তন হোক। যেখানে আমরাই চাই না, সেখানে তাদের এত মাথাব্যথা কেন? এটি মূলত হিন্দুদের ঘরে ঘরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। এই কুচক্রী মহল দীর্ঘদিন থেকে ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে। আমাদের আইন পরিবর্তন করা হবে, অথচ আমরাই জানি না। তাহলে কার স্বার্থে এই চক্রান্ত?’

হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ‘মাহফুজ আনাম ও শাহীন আনাম হিন্দু ধর্ম আইনের সংস্কার চেয়ে যে প্রচারণা চালাচ্ছেন সেটি সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত আন্তর্জাতিক কয়েকটি এনজিও। তারা কেন এ আইনের সংস্কার চায় নিজেরাও বোঝে না। হিন্দু আইন সংস্কার যাদের জন্য প্রয়োজন তারা এ ব্যাপারে কোনো দাবি তোলেনি। শাহীন আনাম না বুঝে হিন্দু আইনের বিরুদ্ধে যেসব অনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছেন, অর্থ ব্যয় করছেন এসব অর্থের উৎস কোথায় তা আমরা জানতে চাই।’

মহাজোটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কান্তি নাগ বলেন, ‘হিন্দু আইন ধর্মীয় অনুভূতির জায়গা। কিন্তু এ অনুভূতির জায়গায় আঘাত হানা হচ্ছে। যারা হিন্দু আইনের পরিবর্তন চাচ্ছে সেখানে কোনো হিন্দু নেই। যেসব এনজিও আইন কমিশনের কাছে হিন্দু আইনের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে সেখানে কোনো হিন্দু প্রতিনিধি নেই, হিন্দু সংগঠন নেই। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার পত্রিকা এবং তাদের গ্রুপ হিন্দু ধর্ম ও আইন নিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করছে।’ 

ইসকনের ফুড ফর লাইফের পরিচালক রুপানুগ গৌরদাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘আমরা কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর এ দর্শনের সঙ্গে একমত না যে, কেউ আমাদের এক গালে চড় দিলে অন্য গাল এগিয়ে দেব। বরং আমাদের দিকে ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার শক্তি যেন আপনাদের থাকে। আমাদের মা-বোনেরা প্রতিবাদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’ 

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হিন্দু মহাজোটের সহসভাপতি প্রদীপ কুমার পাল, মহাসচিব অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, যুগ্ম মহাসচিব সুজন দে, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নরেশ চন্দ্র হালদার, প্রকাশনা সম্পাদক সাগরিকা মন্ডল, হিন্দু মহাজোট ঢাকা মহানগরের সভাপতি ডিকে সমির, বাংলাদেশ মতুয়া মহাসংঘের মহাসচিব সাগর সাধু ঠাকুর, হিন্দু আইন সংশোধন প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জে কে পাল, হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ব্রাহ্মণ সংসদের সভাপতি কর্নেল (অব.) নিরঞ্জন ভট্টাচার্য, মহাসচিব বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য, সৎসংঘ বাংলাদেশের সভাপতি ড. রবীন্দ্রনাথ সরকার, সনাতন বিদ্যার্থী পরিষদের সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুশল চক্রবর্তী, বৈদিক সমাজ বাংলাদেশ সভাপতি স্বামী চিদানন্দ সরস্বতী, বৈদিক কৃষ্টি সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার প্রধান আচার্য রবীন্দ্রনাথ দেবনাথ, যোগী অরুণ জ্যোতি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সহদেব বৈদ্য, হরিগুরু সেবা সংঘের সভাপতি নির্মল ঠাকুর, হিন্দু ল ইয়ার্স অর্গানাইজেশনের সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট নারায়ণ চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শঙ্কর দাস, বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদ সাধারণ সম্পাদক সাজন মিশ্র, হিন্দু মহিলা মহাজোটের সহসভাপতি কাকলী নাগ, দেবী হালদার, সাধারণ সম্পাদক মুক্তা বিশ্বাস, বাংলাদেশ সেবা সংঘের বাবুল হাওলাদারসহ শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি।

সর্বশেষ খবর