সোমবার, ২৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

জাল রুপির কারবারে মিশু সিন্ডিকেট

কারখানা ও সহযোগীদের খোঁজে সিআইডি

আলাউদ্দিন আরিফ

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানে রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, কদমতলী, কেরানীগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় জাল রুপি তৈরির বেশ কিছু কারখানার সন্ধান পেলেও মূল হোতারা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযানে মাঠপর্যায়ের কারিগর ও বাজারজাতকারী কিছু সদস্য গ্রেফতার হয়। কিন্তু কারা তাদের গডফাদার- সে প্রশ্নের জবাব অজানাই থেকে যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বলছেন, সম্প্রতি গ্রেফতার শরিফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান জাল রুপি ও মুদ্রা কারবারি চক্রের প্রধান। দেশের কোথায় কোথায় তার জাল রুপি তৈরির কারখানা আছে এবং কারা সেগুলো চালাচ্ছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। জাল মুদ্রা তৈরির কারখানার সন্ধান পেতে ইতিমধ্যে তারা কয়েকটি অভিযানও চালিয়েছে। জাল মুদ্রা কারবারে জড়িত সন্দেহে মিশু হাসান ও তার অন্যতম সহযোগী মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানের বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে। মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাদের। জিজ্ঞাসাবাদে জাল রুপি তৈরি, বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সীমান্তের ওপারে পাচার-সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন মিশু ও জিসান। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডির ঢাকা মেট্রো বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ মুহূর্তে তদন্তের স্বার্থে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে চাই না।’ ৩ আগস্ট রাতে রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকা থেকে মিশু হাসান ও জিসানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে ৪৯ হাজার ৫০০ জাল মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ভাটারা থানায় ১৯৭৮ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৯(এ) ধারায় মামলা করা হয়। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।

সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, মিশু হাসানের জাল রুপি তৈরির কারবার তদারক করতেন জিসান। কিছুদিন আগে রাজধানীর রামপুরার উলন রোডের পলাশবাগ এলাকার একটি বাড়ির অষ্টম তলায় জাল রুপি তৈরির কারখানা পাওয়া যায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ২১ লাখ জাল রুপি, যার সবই ছিল ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট। ওই অভিযানে রফিকুল ইসলাম ওরফে খসরু, আবদুর রহিম ও জনি ডি কস্তা নামে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। খসরু ছিলেন মিশু হাসান সিন্ডিকেটের সদস্য। জনি ও রহিম ছিলেন কারখানার কর্মচারী। তারা গ্রেফতার হওয়ার পর ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মিশুর নাম এলেও বিস্তারিত তথ্য না পাওয়ায় ওই তদন্ত বেশি দূর এগোয়নি। এ ছাড়া দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের একটি কারখানার সন্ধান পায় র‌্যাব। সেখান থেকে ১০ লাখ জাল রুপি উদ্ধার করা হয়। কদমতলীতেও জাল রুপি তৈরির কারখানার সন্ধান মেলে। এসব কারখানায় জাল রুপি তৈরি করাতেন মিশু হাসান ও জিসান সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

তদন্ত সূত্র জানায়, মিশু হাসান রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় জাল রুপি তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। সাধারণ মানুষ সহজেই জাল টাকা চিনতে পারলেও নিখুঁতভাবে তৈরি করা জাল রুপি চেনা দুরূহ। এ সুযোগ কাজে লাগান মিশু হাসান ও তার সহযোগীরা। নিখুঁতভাবে জাল রুপি তৈরি করে নিজস্ব এজেন্ট ও সিন্ডিকেটভুক্ত মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে তারা ছড়িয়ে দিতেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। এসব জাল রুপি নিয়ে বিদেশে গিয়ে চরম হয়রানি ও বিপদের মুখে পড়েন সাধারণ মানুষ। র‌্যাবের একজন সদস্য বলেন, ‘আমরা তথ্য পেয়েছি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর ও সাতক্ষীরাসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় জাল রুপির কারখানা ছিল মিশু হাসান ও জিসানের। গ্রেফতার হওয়ার পর এসব কারখানা গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা তাদের কাছে অর্ধেক দামে বিক্রি করেন ভারতীয় রুপি। মানি এক্সচেঞ্চগুলোও আসল রুপির চেয়ে কিছুটা কম রেটে জাল রুপি বিক্রি করে। এতে মানুষ লোভে পড়ে জাল রুপি কিনে প্রতারিত হন। চিকিৎসা ও ছোটখাটো ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজে ভারতে যাওয়া সাধারণ মানুষ মানি এক্সচেঞ্জ বা দালালের কাছে এসব মুদ্রা কিনে প্রতারিত হন। আর এসব জালিয়াতির কারবার করে মিশু হাসান ও জিসান সিন্ডিকেট ফুলে ফেঁপে ওঠে অল্প দিনেই।’ তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের মতে, মিশু হাসানের জাল রুপি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে তার বান্ধবী ও ব্যবসায়িক পার্টনার ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাও যুক্ত ছিলেন বলে তথ্য মিলেছে। এর আগে র‌্যাব জানিয়েছে, পিয়াসার দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরেই মিশুকে গ্রেফতার করা হয়। পিয়াসা কয়েক দফা রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলাসহ মিশু-পিয়াসা সিন্ডিকেটের মামলার বিষয়ে সিআইডি প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সিআরপিসি অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে যেভাবে দাখিল করতে হয় আমরা সেভাবে দাখিল করব। এর জন্য সময় লাগবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলা আমাদের কাছে তদন্তাধীন। আমরা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পেয়েছি। আমরা যেসব নাম ও তথ্য পাচ্ছি তার সবই খন্ডচিত্র। প্রাপ্ত তথ্য আইনি দৃষ্টিতে যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হয়ে আদালতে প্রতিবেদন দেব এবং সবকিছু প্রকাশ করব।’

সর্বশেষ খবর