শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আফগানিস্তান সংকটে নতুন মাত্রা

বিমানবন্দরে বিস্ফোরণে নিহত ১৭০ ছাড়িয়েছে, আরও হামলার আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

আফগানিস্তান সংকটে নতুন মাত্রা

আত্মঘাতী বোমা হামলার পর এখনো বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে কাবুল বিমানবন্দরের আশপাশ -এএফপি

কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর আফগানিস্তান সংকটে নতুন মাত্রা তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস-কে। হামলায় মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনায় আরেক দফায় তোপের মুখে পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে বাইডেন এর প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এর মধ্যেই কাবুল বিমানবন্দরে আরও হামলার আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ সমাপ্তির পথে থাকতেই বৃহস্পতিবার ভয়াবহ জোড়া বিস্ফোরণ পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটিয়ে দিচ্ছে। এতে বদলে যেতে পারে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর আগের পরিকল্পনা। কৃষ্ণগহবরে অভিকর্ষের মতো আফগানিস্তান টানতে পারে সিআইএকে। সংস্থাটি ফিরতে পারে জটিল সন্ত্রাসবাদবিরোধী মিশনে, যা চলতে পারে আগামী কয়েক বছর। মধ্যপ্রাচ্যের বার্তা সংস্থা আলজাজিরা জানিয়েছে, তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ১০ দিন পর বৃহস্পতিবার এ জোড়া বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা ১৭০ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৩ মার্কিন সেনাও। আহত হয়েছেন ২০০ জনের বেশি। তালেবানের সঙ্গে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির পর আফগানিস্তানে এই প্রথম মার্কিন সেনা নিহতের ঘটনা ঘটল। হতাহতের মধ্যে বেসামরিক আফগান নারী ও শিশু রয়েছে। হামলার প্রত্যক্ষদর্শী একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাবেক কর্মী রয়টার্সকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ অভিবাসন ভিসা নিয়ে আমি বিমানবন্দরে এসেছিলাম। বিমানবন্দরের অ্যাবে গেটের কাছে লাইনে প্রায় ১০ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। (স্থানীয় সময়) বিকাল ৫টা। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে বিমানবন্দর। মনে হলো আমার পায়ের নিচে থেকে কেউ মাটি সরিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ মনে হলো কানের পর্দা ফেটে গেছে। আমি কিছুই শুনতে পারছিলাম না। ঘূর্ণিঝড়ের সময় প্লাস্টিকের ব্যাগ যেমন করে বাতাসে উড়ে যায় তেমন করে মানুষের শরীর ও হাত-পা উড়ে যেতে দেখলাম। এ জীবনে কিয়ামত দেখা হবে না। কিন্তু আজ নিজের চোখে যা দেখলাম তা যেন কিয়ামতের মতোই। হতাহতদের দেহ রাস্তায় ও পাশের নালায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি।’ নালায় সামান্য পানি রক্তে ভরে উঠেছিল বলেন ওই প্রত্যক্ষদর্শী।

ইতিমধ্যে হামলার দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস খোরাসান শাখা বা আইএস-কে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, এ আইএস-কের পুরো নাম ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রভিন্স। এ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা আফগানিস্তানের বাইরে পাকিস্তানেও সক্রিয়। ফোর্বসের দেওয়া তথ্যানুসারে ঐতিহাসিক খোরাসান অঞ্চলের নাম যুক্ত করে আইএস এ শাখাটির এমন নামকরণ করেছে। ব্রিটানিকা বলছে, এ খোরাসানের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। আজকের ইরান, তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে এলাকাটি। সিএনএন বলছে, তালেবানের সঙ্গে স্পষ্ট শত্রুতা রয়েছে আইএস-কের। ফোর্বসও একই কথা বলছে। কিন্তু বিবিসি বলছে, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আইএস-কে। সেই তৃতীয় পক্ষটি হলো হাক্কানি নেটওয়ার্ক। বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে আইএসের সম্পর্ক রয়েছে। হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি তালেবানেরও নেতা।

এদিকে হামলার পরও দেশ ছাড়তে উদগ্রীবদের কারণে বিমানবন্দরে ভিড় ও বিশৃঙ্খলা কমেনি। কাবুল বিমানবন্দরে জোড়া হামলার পর কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকা উদ্ধার অভিযান আবার শুরু হয়েছে। সেখান থেকে বিদেশি নাগরিকসহ আফগানদের উদ্ধার করে আনার কাজ চলছে। তবে আবার হামলার আশঙ্কা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে বোমা বিস্ফোরণের পরপর কাবুলের মার্কিন দূতাবাস আমেরিকানদের ওই এলাকা থেকে সরে যেতে বলেছে। কাবুলে ফরাসি দূত ডেভিড মার্টিন বিমানবন্দর এলাকায় আরও হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

বিমানবন্দরে জোড়া হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে চীন ও রাশিয়া। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত হতাশাজনক ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে। আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস সেখানকার বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিচ্ছে। আফগানিস্তানে দুশ্চিন্তার কারণে রাশিয়া মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন।’ চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজান এক বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘অসংখ্য মানুষ নিহতের ঘটনায় চীন শোকাহত। এ ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায় আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি কতটা জটিল।’ এদিকে রাজধানী কাবুলে বোমা হামলায় মার্কিন সেনা হতাহতের ঘটনায় তোপের মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের অনেকেই বাইডেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন। আবার অনেকেই তাঁর অভিশংসন দাবি করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বাইডেনের সমালোচনা করেছেন। তবে হামলার পর হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন বলেন, ‘এ হামলার সঙ্গে যে-ই জড়িত থাকুন, জেনে রাখুন আমরা ক্ষমা করব না। আমরা বিষয়টি ভুলেও যাব না। আমরা আপনাদের খুঁজে বের করব। এর মূল্য আপনাদের মেটাতে হবে।’

আফগানিস্তান ছাড়ল পাঁচ দেশ : বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে পাঁচটি দেশ তাদের সব সেনা ও নাগরিক সরিয়ে নিয়েছে। দেশগুলো হলো সুইডেন, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও স্পেন। সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন লিনডের জানিয়েছেন, শুক্রবার (গতকাল) তাদের নাগরিকদের কাবুল থেকে সরিয়ে আনার অভিযান শেষ হয়েছে। তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর ১১ শতাধিক নাগরিককে তারা আফগানিস্তান থেকে ফেরত নিয়ে এসেছে। নরওয়ে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার তাদের নাগরিকদের প্রত্যাহার করে দেশে আনা হয়েছে। তারা আকাশপথে ১ হাজার ৯৮ জনকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। নিউজিল্যান্ড জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে কাবুল থেকে যাত্রীদের নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) পৌঁছায় নিউজিল্যান্ডের একটি ফ্লাইট। আফগানিস্তানে আর কোনো উড়োজাহাজ পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন।

আফগানিস্তান থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম সমাপ্তির কথা ঘোষণা দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার ডাটনও বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার সেনা সদস্যরা কাবুল থেকে ৪ হাজারের বেশি মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছেন। শুক্রবার সকালে কাবুল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে পৌঁছেছে স্পেনের শেষ দুটি ফ্লাইট। আফগানিস্তান ত্যাগ করা স্পেনের শেষ দুটি ফ্লাইটে সেনা সদস্যসহ স্পেনের ৮১ নাগরিক ছিলেন। পাশাপাশি পর্তুগালের চার সেনা ও ৮৫ আফগানও ছিলেন বলে জানানো হয়েছে সরকারি ওই বিবৃতিতে। এ নিয়ে ১ হাজার ৯০০ জনকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিল দেশটি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর