রবিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রলারডুবি

মৃত ২২ জনের মধ্যে ৯ শিশু, গ্রেফতার ৫

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে লইস্কা বিলে শুক্রবার বিকালে যাত্রীবাহী নৌকাডুবির ঘটনায় উদ্ধার ২২ লাশের মধ্যে শিশুই নয়জন এবং নারীর ১১ জন। বাকি দুই লাশ পুরুষের। এ মর্মান্তিক ঘটনায় গতকাল চার স্বজন হারানো এক ব্যক্তি মামলা করেছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে বালুবাহী ট্রলারের (বাল্কহেড) মাঝিসহ পাঁচজনকে। জব্দ করা হয়েছে দুই বাল্কহেড। সাময়িকভাবে দুর্ঘটনাস্থল লইস্কা বিলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নৌকা চলাচল। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে শুরু করেছে তদন্ত। এরই মধ্যে লাশ শনাক্তের পর স্বজনদের হস্তান্তর করা হয়েছে। জানা গেছে, গতকাল দুপুরে সেলিম মিয়া নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে সাতজনের বিরুদ্ধে বিজয়নগর থানায় মামলাটি করেন। পরে আসামি বালুবাহী ট্রলারের মাঝি জমির মিয়া (৩৩), মো. রাসেল (২২), খোকন মিয়া (২২), সোলায়মান (৬৪) ও মিস্টু মিয়াকে (৬৭) গ্রেফতার করা হয়। বাকি দুই আসামির নাম জানায়নি পুলিশ। তবে তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলে জানা গেছে। মামলার বাদী সেলিম মিয়া (৪০) বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের গেরারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। দুর্ঘটনায় তার চার স্বজন মারা গেছেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোজাম্মেল হোসেন রেজা বলেন, এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার এবং দুটি বাল্কহেড (বালুর ইঞ্জিনচালিত নৌকা) জব্দ করা হয়েছে।

যারা নিহত হয়েছেন : গতকাল সকালে পানিতে ভেসে ওঠে নাফসা আক্তার (৩) নামে এক শিশুর লাশ। শহরের পৌর এলাকার উত্তর পৈরতলার বাসিন্দা হারিজ মিয়ার সন্তান সে। সে নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে চাচির সঙ্গে নিখোঁজ হয়। চাচির লাশ শুক্রবার রাতে উদ্ধার হলেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। সকালে তার লাশ ভেসে ওঠে। এ ছাড়া অন্য নিহতরা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চিলোকুট গ্রামের আবদুল্লাহর মেয়ে তাকওয়া (৮), চম্পকনগর গ্রামের জহিরুল হক ভুইয়ার ছেলে মামুন ভুইয়া (২০), গেরারগাঁও গ্রামের মৃত কালু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৬০), জজ মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০), মেয়ে মুন্নি (৬), মৃত আবুল হাশেমের স্ত্রী কমলা বেগম, নুরপুর গ্রামের মৃত আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী মিনারা বেগম, আদমপুর গ্রামের অখিল বিশ্বাসের স্ত্রী অঞ্জলী বিশ্বাস (৩০), সদর উপজেলার পৈরতলা গ্রামের আবু সাঈদের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৫৫), সাদেকপুর গ্রামের ফুয়াদ হোসেনের ছেলে তানভীর (৮), নরসিংসার গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে সাজিম (৭), ভাটপাড়া গ্রামের জারু মিয়ার মেয়ে শারমিন (১৮), উত্তর পৈরতলা গ্রামের ফারুক মিয়ার স্ত্রী কাজলী বেগম, পৌর এলাকার দাতিয়ারা গ্রামের মোবারক মিয়ার মেয়ে তাসফিয়া মীম (১২), ময়মনসিংহ জেলার খোকন মিয়ার স্ত্রী ঝরনা বেগম (৫৫), আদমপুর গ্রামের পরিমল বিশ্বাসের মেয়ে তিথিবা বিশ্বাস (২), মণিপুর গ্রামের হাজী আবদুল বারীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৫৮), বাদেহারিয়া গ্রামের কামাল হোসেনের মেয়ে মাইদা আক্তার (৬), ময়মনসিংহের গোপালপুর গ্রামের শাওনের মেয়ে সাজিদ (৩), বড় পুকুরপাড়ের সোলায়মান মিয়ার স্ত্রী রুবিনা আক্তার, সোনাবর্ষিপাড়ার আবদুল বারী ভুইয়ার স্ত্রী মোসা. নুসরাত জাহান।

লাশ শনাক্তের পর হস্তান্তর : শুক্রবার রাতেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে লাশ শনাক্তের পর স্বজনদের হস্তান্তর শুরু হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন জানান, কিছু লাশ ঘটনাস্থলে স্বজনদের হস্তান্তর করা হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে বাকি লাশ নিয়ে আসা হয়। স্বজনরা লাশ শনাক্তের পর হস্তান্তর করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে ২০টি ও ঘটনাস্থলে দুটি লাশ স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিনা ময়নাতদন্তে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সময় হাসপাতালে শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শত শত মানুষের ভিড় সামলাতে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়।

জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খান জানান, নিহত প্রত্যেকের দাফনের জন্য পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।

নৌকা চলাচল সাময়িক বন্ধ : বিজয়নগরের লইস্কা বিলে নৌকাডুবির পর নৌকা চলাচল বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। শুক্রবার বিকালে মণিপুরে বালুবাহী ট্রলারের ধাক্কায় প্রায় ১০০ যাত্রী নিয়ে নৌকা ডুবে যায়।

উদ্ধারকাজ পরিত্যক্ত : গতকাল দিনভর খোঁজাখুঁজির পর বিকালে জেলা প্রশাসন উদ্ধারকাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয় যদি কারও স্বজন নিখোঁজ থাকে তাহলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু এ আবেদনে কোনো সাড়া না দেওয়ায় প্রশাসন ধরে নেয় আর কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ তালিকায় নেই। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সহকারী পরিচালক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘নৌকাডুবির ঘটনায় আর কেউ নিখোঁজ নেই। তবে কেউ যদি দাবি করেন তাদের স্বজন এখনো নিখোঁজ সে ক্ষেত্রে আমরা আবারও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করব।’

 

তীরে এসে ডুবে গেল তরী : ট্রলারটিতে সবশেষ যাত্রী উঠেছিল মণিপুর ঘাট থেকে। আর মাত্র ১০-১৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই ট্রলারটি পৌঁছে যেত আনন্দবাজার ঘাটে। এটিই ছিল দিনের শেষ খেয়া। কিন্তু তীরের কাছাকাছি এসেও বালুবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে সংঘর্ষে ডুবে যায় শতাধিক যাত্রীবোঝাই ট্রলারটি। মৃত্যু হয় ২২ জনের। ট্রলারডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী আলী আক্তার রেজভী জানান, ট্রলারটি লইস্কা বিল আসার পর বিপরীতগামী বালুবোঝাই ট্রলারের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে যাত্রীবোঝাই ট্রলারটি ডুবে যায়। কয়েকজন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকেই পানিতে তলিয়ে যান।

দিশাহারা মোমেনা বেগমের পরিবার : মোমেনা বেগম। বয়স ৫৭ বছর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের গভর্নমেন্ট মডেল গার্লস হাইস্কুলের এমএলএসএস পদে কর্মরত ছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ট্রলারডুবির ঘটনায় নিহতের মধ্যে মোমেনা একজন। শুক্রবার সকালে স্বামী আবু সাঈদের সঙ্গে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলেন চম্পকনগরে। বিকালে বাড়ি ফেরার পথে নৌকাডুবির ঘটনায় প্রাণ হারান মোমেনা। তার স্বামী বৃদ্ধ আবু সাঈদ প্রাণে বেঁচে গেছেন। নিহতের ছোট ছেলে ফাহিম বলেন, ‘আমার বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। আমরা তিন ভাই, এক বোন। মায়ের চাকরির বেতনে সংসার চলত। ঘরে বিয়ের উপযুক্ত একমাত্র বোন রয়েছে। এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। বড় ভাই টাইলস ফিটিংয়ের কাজ শিখছেন। আমি নিজেও বেকার।’

ডাক্তারের কাছে যাওয়া হলো না মা-মেয়ের : স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০) ও মেয়ে মুন্নিকে (৬) বাড়ির পাশের খেয়াঘাট থেকে বিকালে ট্রলারে তুলে দেন জজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রীর কোমরে ব্যথা ছিল। গতকাল সকালে ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর সুযোগ হয়নি তাদের। দুপুরে বাড়ির পাশে কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।’ জজ মিয়া উপযুক্ত বিচার দাবি করেন ট্রলার মালিক ও চালকদের। তিনি বিলেন, ‘আমি বারবার ট্রলার চালককে বলেছি যাত্রী কম নিতে কিন্তু তারা কথা শোনেনি।’

ট্রলার ডুবে গেরারগাঁও গ্রামের আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন মঞ্জু বেগম (৬০) ও কমলা বেগম (৬৫)। মায়ের জন্য বিলাপ করতে করতে মঞ্জু বেগমের মেয়ে মৌসুমি বলেন, ‘আমার নানু অসুস্থ। সেজন্য চাচি কমলা বেগমকে নিয়ে নানুবাড়ি যাচ্ছিলেন মা। ভাতার জন্য কয়েকদিন আগে মা ছবি তুলেছিলেন। সে ছবি আমার কাছে দিয়ে বলেছিলেন বাবার ছবির সঙ্গে বাঁধিয়ে রাখতে। আমি তখন বুঝতে পারিনি আমার মা এভাবে ছবি হয়ে যাবেন।’

সর্বশেষ খবর