সোমবার, ৩০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

জিয়া এরশাদ খালেদা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত না

------ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জিয়া এরশাদ খালেদা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া এরা কেউই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত না। তারা সাধারণ মানুষের উন্নতিতে বিশ্বাস করত না। তা যদি করত তাহলে ১২ বছরের মধ্যে আমরা যেটা করতে পেরেছি, তারা সেটা ২১ বছরে করতে পারত, কিন্তু করেনি।

গতকাল সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন।   

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর সেই  স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যায়। যারা পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসে তারা অনেক বড় বড় কথা বলেই এসেছিল। জাতির পিতার প্রতি অনেক কুৎসা রটনা করেছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সব চেতনা নষ্ট করেছিল। তারা দেশের উন্নয়নে কাজ করেনি। কারণ তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসই করত না। তিনি বলেন, ২১টা বছর এ দেশের মানুষের জীবনের কোনো উন্নয়নের দিকে, যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা তাকায়নি। ক্ষমতা তাদের কাছে ভোগের বস্তু ছিল, লুটপাটের জায়গা ছিল। বাংলাদেশের মানুষ যে অবহেলিত, সেই অবহেলিত থেকে যায়। যতটুকু জাতির পিতা করে গিয়েছিলেন, তার থেকেও পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়।

কক্সবাজার হবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সৈকত ও পর্যটন কেন্দ্র : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কক্সবাজার হবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সমুদ্র সৈকত এবং পর্যটন কেন্দ্র। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময়। তাই বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একটা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে চাই। তিনি বলেন, বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ বিশ্ব যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলেও আগামীতে বাংলাদেশ সেই কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত এবং পর্যটনের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, অনেক চিন্তা ও পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে এবং কক্সবাজার নিয়ে তো আরও বেশি। সেভাবেই পুরো কক্সবাজারটাকে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ করব। কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই রানওয়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে যে ওয়াদা জনগণের কাছে দিয়েছিলাম, সেখানে আরও একটা ধাপ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

শেখ হাসিনা বলেন, এই বিমানবন্দর সম্প্রসারণ হলে পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যে বা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে যত প্লেন যাবে তাদের রিফুয়েলিংয়ের জন্য সব থেকে সুবিধাজনক জায়গা হবে এই কক্সবাজার। কারণ, একেক সময় পৃথিবীর একেকটি জায়গা উঠে আসে। এক সময় হংকং, তারপর সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক এখন দুবাই। কিন্তু আমি বলতে পারি, ভবিষ্যতে কক্সবাজারটাই হবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কেননা, খুব স্বল্প সময়ে এখানে বিমান এসে নামতে এবং রিফুয়েলিং করে চলে যেতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে এই যে জলভাগের ওপর আমরা একটা রানওয়ে নির্মাণ করছি, সেটাও দৃষ্টিনন্দন হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিউইয়র্ক, টরেন্টো, সিডনির মতো দূরত্বে চলার মতো আমাদের ড্রিমলাইনার ও অন্যান্য বিমান আছে। বিশেষ করে আমাদের দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হলে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হবে। তিনি বলেন, আমরা শুধু পশ্চিমাদের দিকে মুখ করে থাকব না। পাশাপাশি আমরা অন্যান্য যেসব বন্ধুপ্রতিম দেশ আছে, সেখানে আমাদের বিমান যাতে যায়, ভবিষ্যতে সেই চেষ্টা করব। সরকার দেশের প্রত্যেকটা বিমানবন্দরের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকেও তাঁর সরকার উন্নত করতে চাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা আঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসেবে যেন উন্নত হয়, যাতে ভুটান, নেপাল বা ভারতের কয়েকটা রাজ্য এই বিমানবন্দরটা ব্যবহার করতে পারে, সেভাবে এটাকে একটা আঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসেবে আমরা উন্নত করতে চাই। আর সিলেট সেটা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানেও মেঘালয়, আসাম বা ভারতের অনেক রাজ্য থেকে তারা আমাদের এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরটাও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানেও ত্রিপুরা থেকে শুরু করে ভারতের অনেক প্রদেশ এটা ব্যবহার করতে পারে। সেভাবে একটা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা তৈরি করা এবং সেভাবে উন্নত করা, সেই চিন্তা আমাদের মাথায় রয়েছে।  বিমানের কর্মকর্তাদের কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে  শেখ হাসিনা বলেন, সততার সঙ্গে, দক্ষতার সঙ্গে এটা (বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস) পরিচালনা করবেন। সিভিল এভিয়েশন নিরাপত্তা থেকে শুরু করে সবকিছু যাতে আন্তর্জাতিক মানের হয় সেটা আপনারা দেখবেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত সাড়ে ১২ বছরে বোয়িং কোম্পানির ড্রিমলাইনারসহ মোট ১৬টি অত্যাধুনিক বিমান যুক্ত করেছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪টি বোয়িং-৭৭৭, ২টি বোয়িং-৭৩৭ ও ৪টি বোয়িং-৭৮৭-৮, ২টি বোয়িং-৭৮৭-৯ ও ৪টি ড্যাশ-৮।

প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে বলেন, আমরা ‘রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল বিমানবন্দরকেও উন্নত করব। ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ, নতুন রাডার স্থাপন ও জেট ফুয়েল সরবরাহ করার জন্য পাইপলাইন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করব। কক্সবাজারকে সুপিরিয়র বিমান অবতরণে সক্ষম দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করব। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এ কাজ তাঁর সরকার সম্পন্ন করতে পারবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বলতেন বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানটা এমন যে, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। অর্থাৎ প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সেতুবন্ধ এই বাংলাদেশ রচনা করতে পারে। সেই সুযোগটা আমাদের রয়েছে। কারণ, ইন্টারন্যাশনাল এয়াররুট বাংলাদেশের ওপর দিয়ে, কক্সবাজারের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। কাজেই কক্সবাজারকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধ হিসেবে গড়ে তুলতে এখানে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করা তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

জাতির পিতা ১৯৭২ সালেই সব বিমানবন্দরকে পুনর্গঠন করে চলাচলের উপযোগী করে তুলেছিলেন এবং ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস’ প্রতিষ্ঠা করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এভাবেই তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলেছিলেন। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনঃস্থাপিত করতে পেরেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। নেদারল্যান্ডস, আফগানিস্তান, রাশিয়া ও যুগোশ্লাভিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিমান চলাচল চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বিমানের এক সময়ের দূরবস্থার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আকাশপথে যেতে যেতে পানি পড়ত, এন্টারটেইনমেন্টের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই মান্ধাত্বার আমলের বিমান চালাতে পারায় তিনি সে সময়কার পাইলটদের দক্ষতার কদর করে বলেন, আমি আমাদের পাইলটদের বলতাম তাদেরকে আমাদের স্পেশাল পুরস্কার দেওয়া উচিত। বিমানে ভ্রমণের সময় অনুমতি নিয়ে শেখ হাসিনা ককপিটে গিয়ে পাইলটদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যার কথাও শুনতেন বলে বক্তব্যে জানান তিনি। তিনি বলেন, আমাদের প্রবাসে ১ কোটির কাছাকাছি মানুষ থাকে। তারা কিন্তু আমাদের নিজস্ব প্লেন পেলেই সেটাতে চড়তে চায়। তাতে যত কষ্টই হোক। কিন্তু যেই অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হতো। বিমানে চড়ার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার আছে। কিন্তু তারপরও মনে হতো নিজের দেশের জাহাজে যাচ্ছি। এটাই সব থেকে বড় কথা ছিল।

বাবার সঙ্গে কক্সবাজারে বেড়ানোর স্মৃতিচারণ : কক্সবাজার বিমানবন্দরে রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সেখানে বেড়ানোর স্মৃতিচারণা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা টান ছিল। প্রতি বছর শীতকালে তিনি আমাদের নিয়ে যেতেন। তাঁর সঙ্গে আমরা একবার উখিয়ার গহিন জঙ্গলে গিয়েছিলাম। সেখানে হাতি আসত, বাঘও ছিল। যদিও এখন সেসবের চিহ্ন নেই। কক্সবাজার সৈকতের দৃষ্টিনন্দন ঝাউবনটাও বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে করা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুকাময় সৈকতকে পরিকল্পিতভাবে সাজানোর। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর সেই স্বপ্ন অধরা থেকে যায়।

কক্সবাজার নিয়ে ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু একবার তাঁদের স্পিডবোটে করে সোনাদিয়ায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন সমুদ্র প্রচ- উত্তাল ছিল বলে সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য তাঁরা সোনাদিয়া, মহেশখালী, সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও টেকনাফ গিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরে নামলে আগে শুঁটকির গন্ধ ভেসে আসত। কারণ, বিমানবন্দরের পাশে শুঁটকি উৎপাদনের মহাল। এখন সমুদ্রের জলভাগে দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে তৈরি হচ্ছে, শুঁটকির গন্ধ আর পাওয়া যাবে না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১ হাজার ৭০০ ফুটের সম্প্রসারিত রানওয়ের নির্মাণকাজ শেষ হলে কক্সবাজার হবে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের এক আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র। কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রান্ত থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। বিমান বাহিনী প্রধান শেখ আবদুল হান্নানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস গণভবনে ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

সর্বশেষ খবর