মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার

অনুসন্ধান-তদন্ত বন্ধ দেড় বছর!

অভিযোগ ৭৭৮, তদন্ত ১১ বছরে শেষ মাত্র ৭৮টির, ৩০ তদন্ত কর্মকর্তার পদে কাজ করছেন ১০ জন

আরাফাত মুন্না

অনুসন্ধান-তদন্ত বন্ধ দেড় বছর!

দেড় বছর ধরে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ একরকম বন্ধ রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায়। এ সংক্রান্ত তদন্তকাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না তদন্ত কর্মকর্তাদের। এ সময়ের মধ্যে কোনো প্রতিবেদনও দিতে পারেনি তারা। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন করোনাকালীন সীমাবদ্ধতা ও লোকবল সংকটের কথা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো ঘটনায় ৩ হাজার ৮৩৯ জনের বিরুদ্ধে ৭৭৮টি অভিযোগ জমা পড়েছিল এই সংস্থায়। গত ১১ বছরে মাত্র ৭৮টির তদন্ত শেষ করতে পেরেছে সংস্থাটি। আর একই সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ঢাকার পুরাতন হাই কোর্ট ভবনে থাকা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছে ৪২টি মামলায়।

তদন্ত না হওয়া ৭০০ অভিযোগের বিষয়ে সংস্থার সংশ্লিষ্টরা জানান, মুজিববর্ষ সামনে রেখে একটি ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ হাতে নেওয়া হয়েছিল। যার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই শেষে অন্তত ৫০ শতাংশ অভিযোগ নিষ্পত্তি করার একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু গত বছর মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ায় তা আর এগোয়নি। তবে শিগগিরই দুটি অভিযোগের বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংস্থার প্রধান। ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, বর্তমানে যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে আগামী ১০ বছরেও এই ৭০০ অভিযোগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। একদিকে ট্রাইব্যুনালের লোকবল সংকট, অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তির গতিও একটি কারণ। এ ছাড়া করোনার প্রভাব তো রয়েছেই। সূত্রটি জানায়, তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গড়ে চার থেকে পাঁচটি রায় হয় বছরে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৩৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তিতেই কয়েক বছর চলে যাবে। বাকিগুলোর তদন্ত শেষে বিচার বহুদূর। জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তদন্তকাজে বিলম্বের পেছনে মূলত লোকবল সংকট দায়ী। সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তার পদ ৩০টি। এখানে কাজ করছেন মাত্র ১০ জন। সহযোগিতায় যারা কাজ করেন, সেখানেও পর্যাপ্ত জনবল নেই। তিনি বলেন, গত বছর করোনার সংক্রমণ শুরুর আগে আমরা সর্বশেষ প্রতিবেদন দিতে পেরেছিলাম। এরপর করোনার কারণে দফায় দফায় বিধিনিষেধ জারি হওয়ায় আমাদের কাজ করতে অনেক সমস্যা হয়েছে। তাই তদন্তাধীন থাকা অভিযোগগুলোরও প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আশা করছি খুব শিগগিরই দুটি অভিযোগের প্রতিবেদন দিতে পারব। তিনি বলেন, শুরু থেকে যেসব অভিযোগ এসেছে তার সব যে মামলা এবং অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করা হবে বিষয়টি এমন নয়। কিছু নামের অস্তিত্ব নেই। কেউ কেউ মারা গেছেন। কিছু অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ক্রাশ প্রোগ্রামটা বাস্তবায়ন করতে পারলে সংস্থার কাজ অনেক দূর এগিয়ে যেত বলেও মনে করেন সংস্থাটির প্রধান সমন্বয়ক।

শুরু থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছে দাবি করেন প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, লোকবল সংকটসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের তদন্ত সংস্থা যথেষ্ট ভালো কাজ করছে। তিনি বলেন, তদন্ত সংস্থার প্রধান আবদুল হান্নান খান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনি একজন চৌকশ গোয়েন্দা ছিলেন। তার মৃত্যুর পর কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংস্থা। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের মৃত্যুও আমাদের অন্ধকারে ফেলে দিয়েছে। তবে আমরা আশা করছি, খুব শিগগিরই সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব। তদন্ত সংস্থার সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তাপস কান্তি বল বলেন, তাদের লোকবল সংকটই এখন বড় সমস্যা। অনুমোদিত পদে চৌকশ তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া গেলে তদন্তকাজ আরও গতি পাবে বলে মনে করছি।

জানা গেছে, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রথমে একটি ট্রাইব্যুনাল থাকলেও বিচারকাজে গতি আনতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। শীর্ষ ছয়জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে একটি করা হয়। তবে করোনা পরিস্থিতিতে গত দেড় বছরে খুব কম সময়ই স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম চলেছে ট্রাইব্যুনালে।

গত বছর থেকে ১৪ মাস রায়-বিহীন থাকার পর গত ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের ৪২তম রায় আসে। ৪২ মামলার বিচারে ১২৪ জন আসামির মধ্যে ৬৯ জনের মৃত্যুদন্ডের রায় হয়েছে। মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় ১২ জন আসামি মারা গেছেন। খালাস পেয়েছেন ১ জন। এখন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে ৩৫টি মামলা।

সর্বশেষ খবর