শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ইয়াবা পাচারে বিদেশি সাত রুট

জড়িত দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসী গ্রুপ

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারে অন্তত সাতটি আন্তর্জাতিক রুট ব্যবহার করছে দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসী গ্রুপ। মিয়ানমারভিত্তিক কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী চক্র এসব আন্তর্জাতিক ড্রাগ রুট নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ইয়াবা, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক পাচারে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

ইয়াবার আন্তর্জাতিক রুট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার। তিনি মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুটের একটি ম্যাপও তৈরি করেছেন। তার মতে মিয়ানমার ও ভারতের সাতটি আন্তর্জাতিক রুট দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে ইয়াবার চালান। ইয়াবা পাচারে জড়িত আন্তর্জাতিক কয়েকটি চক্র।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মতে সান স্টেট থেকে প্রতি বছর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইয়াবা, হেরোইনসহ নানান ধরনের মাদক পাচার হয়। যার বার্ষিক বাজারমূল্য ৬১ বিলিয়ন ডলার। ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট-২০২১ অনুযায়ী গত এক বছরে বাংলাদেশ ২ হাজার ৭৪০ কেজি মেথ, ৩২৩ কেজি হেরোইন; মিয়ানমার ১৯ হাজার ২১১ কেজি মেথ, ৬৯০ কেজি হেরোইন; ভারত ১ হাজার ৬২৫ কেজি মেথ, ১৪৯ কেজি এমফিটামিন, ৩ হাজার ২৩১ কেজি হেরোইন; চীন ২৫ হাজার ১০২ কেজি মেথ, ৬ হাজার ১৩৬ কেজি হেরোইন; থাইল্যান্ড ৫৩ হাজার ১৯৩ কেজি মেথ ও ৭২৩ কেজি হেরোইন জব্দ করে। বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে জব্দ এসব মাদকের সিংহভাগেরই উৎস ছিল মিয়ানমারের সান স্টেট। অনুসন্ধানে জানা যায়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভয়ংকর নেশা ইয়াবার মূল উপাদান মেথামফিটামিন বা এমফিটামিনের জোগান আসে মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে। মাদকের রাজধানী হিসেবে পরিচিত সান স্টেট থেকেই বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডে এমফিটামিনের জোগান আসে। যার মধ্যে সান স্টেট-মান্দালে হয়ে কমপক্ষে সাতটি আন্তর্জাতিক রুট দিয়ে বাংলাদেশ আসছে মরণ নেশা ইয়াবা কিংবা এমফিটামিন। সান স্টেট থেকে ইয়াবা রুটের একটি হচ্ছে সান স্টেট-তুয়াঙ্গি-ইয়াঙ্গুন হয়ে নৌপথে সিত্তেই (মিয়ানমার) হয়ে বাংলাদেশর মহেশখালী। একইভাবে সিত্তে রুট ব্যবহার করে বরিশালের উপকূলীয় এলাকায় যায় ইয়াবার চালান। ইয়াবার অন্য রুট হচ্ছে মান্দালে-তুয়াঙ্গি-মাগওয়ে-মিনবু-পাদান-সিত্তেই-মংডু হয়ে টেকনাফ। ইয়াবার কিছু কিছু চালান ভারত হয়েও বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ রুটগুলো মধ্যে হচ্ছে- মান্দালে-সাগাইং অঞ্চল-মনেয়া-কালে-মোরে (মণিপুর)-আইজল (মিজোরাম)-পানিসাগর-শিলং-করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত। শিলং-শিলিগুড়ি-মালদা হয়ে যশোর এবং সাতক্ষীরার তিনটি রুট ব্যবহার করে ইয়াবার মাদক মাফিয়ারা। সান স্টেট থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইয়াবা পাচারে জড়িত মিয়ানমারভিত্তিক কমপক্ষে সাতটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। যার মধ্যে রয়েছে সান স্টেটভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ, ইইনাইটেড স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউসিএ), আরাকান আর্মি, মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়া বাহিনীসহ কমপক্ষে সাতটি চক্র।

দেশে নতুন রুট বান্দরবান সীমান্তের ১০ পয়েন্ট : দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা পাচারের নতুন রুট হয়ে উঠেছে বান্দরবানের দুর্গম নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত। এ উপজেলার অন্তত ১০টি পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারে থেকে আসছে মরণ নেশা ইয়াবা। তারপর সড়কপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হচ্ছে। এ অবৈধ ব্যবসা কেন্দ্র করে এখানে রয়েছে ১০টি সিন্ডিকেটের শতাধিক মাদক কারবারি।

বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের বাণিজ্য কেন্দ্র টেকনাফ আগে ইয়াবার স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাঁড়াশি অভিযানের কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রুট পরিবর্তন করেছে। এখন অনেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এ উপজেলার ১০ পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা আসছে বাংলাদেশে। স্থানীয়দের মতে টেকনাফের মতো এখানে নেই যত্রতত্র অভিযান, টহল, তল্লাশি, ধরপাকড়। আর এ সুযোগে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ঘুমধুম, বাইশফাঁড়ি, রেজু আমতলী, সোনাইছড়ি, নিকুছড়ি, চাকঢালা, আশারতলী, চেরারকুল, কম্বনিয়া ও ফুলতলী পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসে। স্থানীয়দের তথ্যমতে ইয়াবার চালান মিয়ানমার থেকে আনার পর সীমান্তঘেঁষা এলাকার বিভিন্ন বসতবাড়ি ও জঙ্গলে মজুদ করা হয়। পরে মোটরসাইকেল, সিএনজি, মাইক্রোবাস, চাঁদের গাড়ি, রিকশা এমনকি কাঠবোঝাই ট্রাকে যাত্রী ও কর্মজীবী সেজে এসব ইয়াবা পাচার করা হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। এ ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল ও সড়ক পরিবর্তন করে। যেমন চাকঢালা, আশারতলী, কম্বনিয়া, চেরারকুল সীমান্ত থেকে আসা ইয়াবা নাইক্ষ্যংছড়ির কলেজ রোড, রেস্ট হাউস রোড, সোনাইছড়ি রোড, রূপনগর রুট ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে রামু উপজেলার মৌলভীর কাটা, কচ্ছপিয়া-গর্জনিয়া ও শাহ সুজা সড়ক হয়ে পাচার হয়। সীমান্তের নিকুছড়ি থেকে আসা ইয়াবা আমতলী মাঠ, চাকঢালাসহ সোনাইছড়ি-ভগবান টিলা ও মরিচ্যা হয়ে পাচার হয়। রেজু আমতলী পয়েন্ট হয়ে আসা ইয়াবা ঘুমধুম-উখিয়া-সোনাইছড়ি নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে পাচার হয়।

এ ক্ষেত্রে ঘুমধুম কাস্টম, বৈদ্যছড়া বাজার, গর্জনবনিয়া, সোনাইছড়ি হেডম্যানপাড়া, লামারপাড়া, চাকঢালা বাজার, আশারতলী ব্রিজ, আমতলী মাঠ, নাইক্ষ্যংছড়ি থানা মোড়, উপজেলা পরিষদ চত্বর, সোনাইছড়ি বটতলী, নাইক্ষ্যংছড়ি মসজিদঘোনা, বিছামারা, রূপনগর, জারুলিয়াছিড়, কচ্ছপিয়ার তুলাতলী স্টিল ব্রিজ, সিকদারপাড়া-শাহ সুজা সড়ক, মৌলভীর কাটা, তিতারপাড়া, রামুর বাইপাস, রাবারবাগান এলাকা থেকে ইয়াবার চালান হাতবদল হয়।

মাদক কারবারিরা পরিবহনযোগে ইয়াবা পাচারের সময় একাধিক মোটরসাইকেল, সিএনজি, চেকপোস্টের কর্মচারী ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সোর্সের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান ও টহলের আগাম তথ্য পেয়ে যায় মাদক কারবারিরা। তারা কৌশল পরিবর্তন করে নাইক্ষ্যংছড়ি পার হয়ে গেলেও অনেক সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে আটক হয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ির বহু ইয়াবা চালান।

বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়িতে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে কথিত জনপ্রতিনিধি, ঠিকাদার, ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তি, কাঠ ব্যবসায়ী, ইজারাদার, ফার্মেসি ব্যবসায়ী, মোটরসাইকেল চালক, বাগান মালিক, মোবাইল দোকানদার, চাকরিজীবী, ওষুধ কোম্পানির এমআরসহ বিভিন্ন পেশার শতাধিক ইয়াবা পাচারকারী সক্রিয় রয়েছে। যারা নিজেদের আগেকার পেশা পুঁজি করে বর্তমানে মরণ নেশা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা এলাকায় কেউ রাজনীতিবিদ, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ঠিকাদার, আবার কেউ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে মাদক ব্যবসা করে অবৈধ টাকা মজুদসহ ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবর্তন করেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাস্তার ধারে বসে দৈনিক ৫০-১০০ টাকা আয় করা ছেলে লাখো-কোটি টাকার মালিক। অন্যের প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনে চাকরি করা যুবক আলিশান গাড়ি-বাড়ির মালিক। ট্যাক্সি চালিয়ে কিংবা ক্ষুদ্র দোকান করে কীভাবে কোটিপতি বনে? এভাবে নাইক্ষ্যংছড়ির অসংখ্য মানুষ রাতারাতি পরিবর্তন হয়েছে। অবৈধ মাদক ব্যবসা ছাড়া এ পরিবর্তন মোটেও সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশাসন তাদের বিষয়ে কখনো খোঁজ নিয়েছে বলে মনে হয় না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর