শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

চীন ভিয়েতনামকে ফের ছাড়িয়ে বাংলাদেশ

তৈরি পোশাক খাতে বিস্ময়কর সাফল্যের ধারা অব্যাহত

রুহুল আমিন রাসেল

চীন ভিয়েতনামকে ফের ছাড়িয়ে বাংলাদেশ

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামকে আবারও ছাড়িয়েছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। ফলে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক খাতে বিস্ময়কর সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখে ফের দ্বিতীয় অবস্থানে আসছে বাংলাদেশ। ইপিবি, ওটেক্সা ও ভিয়েট্রেডের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটেক্সা) প্রতিবেদন বলছে, করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে চীন ও ভিয়েতনামকে টপকে গেছে বাংলাদেশ। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও ভিয়েতনামের ট্রেড প্রমোশন কাউন্সিল বা ভিয়েট্রেড পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকপণ্য রপ্তানির বৈশ্বিক বাজারে আরেকবার ভিয়েতনামকে টপকে গেছে বাংলাদেশ।

তবে বাংলাদেশ এখন ভিয়েতনামের তুলনায় পরিমাণে বেশি রপ্তানি করলেও এখনই দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক বলা যাবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য সব দেশের বাণিজ্য পর্যালোচনায় বিভিন্ন দেশের বছরওয়ারি অবস্থানের তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলবে। এ প্রসঙ্গে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকপণ্য রপ্তানির এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের টার্গেট অর্জন সম্ভব হবে। এর আগে রপ্তানির টার্গেট অর্জনে পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তি কমাতে হবে। পণ্য আমদানি, রপ্তানি ও সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা কমাতে পারলে রপ্তানির সম্ভাবনা আরও বাড়বে।

তিনি বলেন, চলতি পঞ্জিকা বছর শেষে ডব্লিউটিওর প্রতিবেদন বাংলাদেশের পক্ষেই আসবে। বছর শেষে ভিয়েতনামের তুলনায় কমপক্ষে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি থাকবে বাংলাদেশের। তার যুক্তি, উদ্যোক্তাদের হাতে প্রচুর রপ্তানি আদেশ। দুই ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে সংস্কার উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতের শিল্পপরিবেশ এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) উপদেষ্টা ও সংগঠনটির সাবেক প্রথম সহসভাপতি এ এইচ আসলাম সানী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো চীনবিমুখ হওয়ায় বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়ছে। বিশেষ করে কম দামের পোশাকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তবে তৈরি পোশাকপণ্য উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল সুতার সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় জটিলতায় পড়েছেন বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা। ফলে ক্রেতাদের চাহিদা মোতাবেক সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়েছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত বছরের মার্চে দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর কয়েক দফা লকডাউনে মোট ৬৫ দিন পোশাক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ সুযোগে ভিয়েতনাম পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে যায়। ডব্লিউটিও পর্যালোচনা প্রতিবেদনে ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা হারায় বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০০ কোটি ডলারের পোশাক বেশি রপ্তানি করে ভিয়েতনাম। ওই বছর বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ভিয়েতনামের এ পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।

ইপিবি ও ভিয়েট্রেড পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ১ হাজার ৮৮০ কোটি ডলার। একই সময়ে ভিয়েতনামের রপ্তানির মোট পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৮৬ কোটি ডলার। ফলে বছরের শুরুতেই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। জানুয়ারিতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৮৬ কোটি ডলার। ভিয়েতনামের এ পরিমাণ ছিল ২৬৬ কোটি ডলার। পরের মাসে ব্যবধান আরও বাড়ে। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ২৬৩ কোটি ডলারের বিপরীতে ভিয়েতনামের এ পরিমাণ ছিল ১১৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাসটিতে ভিয়েতনামের রপ্তানি বাংলাদেশের অর্ধেক। মার্চে অবশ্য ভিয়েতনাম এগিয়ে যায় সামান্য ব্যবধানে। এপ্রিলে আবারও ভিয়েতনামের দ্বিগুণ দাঁড়ায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি। সর্বশেষ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসের পরিসংখ্যানে মোট রপ্তানিতে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে একক দেশ হিসেবে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকপণ্যের চাহিদা বাড়ছেই। জানা গেছে, মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে মার্কিনিদের আয় কমেছে। ফলে তারা স্বাভাবিক নিয়মেই কম দামের পোশাকপণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। ভোক্তাদের এ চাহিদা বিবেচনা করেই ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশের মতো কম দামি পোশাক উৎপাদক ও সরবরাহকারী দেশগুলোতে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন। এর সঙ্গে মার্কিন ক্রেতাদের চীনবিমুখতা, মিয়ানমারে সামরিক সরকার ও ভিয়েতনামে চলমান লকডাউন ব্যাপক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন দেশীয় পোশাকশিল্প মালিকরা।

মার্কিন সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএসএফআইএ) পৃষ্ঠপোষকতায় ও ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের ফ্যাশন অ্যান্ড অ্যাপারেল স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শেং লুর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘২০২১ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্কিং স্টাডি’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদন বলছে, একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। আগামী দুই বছর এ প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় থাকবে। এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ থেকে মূল্যসুবিধা পাওয়া যায় তুলনামূলক বেশি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পোশাকপণ্য আমদানির পরিসংখ্যান সম্পর্কে অটেক্সার আগস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর এ ক্ষেত্রে ২৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে চীনের।

অটেক্সার প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৩১৩ কোটি ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানির এ আয়ের প্রবৃদ্ধি দেশটিতে পোশাক রপ্তানিকারক শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত জুলাই পর্যন্ত এক বছরে ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে ১ হাজার ৩৭৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত এক বছরে এ আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ করোনার ধাক্কা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে থাকা মার্কিন বাজারে ভিয়েতনামি পোশাকের রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মার্কিন বাজারে ভিয়েতনামের পোশাক আয় বেড়েছে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এখানে ২৬ দশমিক ৮১ শতাংশ।

অটেক্সার হিসাব বলছে, চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে লাগাতার কমছে চীনা পোশাকের কদর। গত বছর জুলাই পর্যন্ত মার্কিন পোশাকের বাজারের ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ দখলে ছিল চীনের। বর্তমানে এই দখলদারি নেমে এসেছে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মার্কিন বাজার হারিয়েছে চীনা পোশাক। চীনের এই হারিয়ে যাওয়া বাজার দখলে মরিয়া বাংলাদেশ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা মোট পোশাকের (ডলারের হিসাবে) ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ সরবরাহ করে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মেড ইন বাংলাদেশ, গত বছরের জুলাই পর্যন্ত যা ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর