শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্যবসায়ীদের মেরে ব্যাংক বাঁচানো যাবে না

ব্যাংক এমডিদের সঙ্গে বৈঠকে এফবিসিসিআই । ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তি দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চায় এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠনটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের বলেছে- যারা অভ্যাসগত

ঋণখেলাপি, তাদের সঙ্গে এফবিসিসিআই নেই। ১ শতাংশের কারণে ৯৯ শতাংশ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। আবার অনেক অনিচ্ছাকৃত খেলাপিও আছেন। করোনাকালে সরকারি প্রণোদনা ব্যাংকের জন্যও এক ধরনের ব্যবসা। এখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ না দিলে কয়দিন পরে টাকা দেওয়ার লোক পাবেন না। ব্যবসায়ীদের মেরে ব্যাংক বাঁচানো যাবে না। ব্যাংকও বাঁচাতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও বাঁচাতে হবে। বড়দের ঋণ দেবেন, ছোটদের মেরে ফেলবেন, এটা হতে পারে না।

গতকাল রাজধানীর বনানীতে শেরাটন হোটেলে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআই আয়োজিত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। এতে এফবিসিসিআই সহসভাপতি আমিন হেলালী, আমিনুল হক শামীম, হাবিব উল্লাহ ডন, এম এ রাজ্জাক খান, সংগঠনটির পরিচালকসহ ৩২টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক-এমডি ও প্রধান নির্বাহী উপস্থিত ছিলেন।

‘বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় ব্যাংকিং খাতের ভূমিকা : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ কেন বাড়ছে না পর্যালোচনা করতে হবে। অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের সহায়তা দিতে হবে। শিল্প ঋণ পুনঃতফসিলে ডাউনপেমেন্টের হার সর্বোচ্চ ১ থেকে ২ শতাংশ নির্ধারণ করলে দেশের শিল্পায়ন সহজ হবে। শিল্পকারখানার জন্য ১৫ বছর মেয়াদি ঋণ দরকার। কিন্তু তা ব্যাংক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এসএমই-দের চলতি মূলধনের চাহিদা পূরণে চলমান ঋণ মঞ্জুর অব্যাহত রাখার এবং ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে মেয়াদি ঋণের সময়সীমা ১ বছর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩৫ বছর পর্যন্ত রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়াদি ঋণের সময়সীমা ১ বছর হয়ে থাকে যার ফলে ঋণ পরিশোধে সমস্যা দেখা দেয়। এসএমই খাতের টার্মলোনের (মেয়াদি ঋণ) মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদি (৭-১০ বছর মেয়াদি) করার পাশাপাশি গ্রেস পিরিয়ড দুই বছর করা জরুরি। এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, একটি গ্রুপের কোনো একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে, বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও ঋণ পায় না। এটা গ্রুপের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থাকে নাজুক করে তোলে। এ বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। ওই মতবিনিময় সভায় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ-এবিবি’র চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, প্রণোদনা ঋণ, কোনো অনুদান নয়। ঋণের টাকা সঠিক সময়ে ফেরত আনা ব্যাংকের দায়িত্ব। টাকা আদায় নিয়ন্ত্রণ সংস্থারও দায়িত্ব নয়। তাই ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিচ্ছে। খেলাপি ঋণ পুরো খাতকে ক্ষতিতে ফেলেছে। ঋণ খারাপ হলে তা আদায় করতে ১০ বছর সময় লেগে যাচ্ছে। আমানতকারীদের থেকে তো টাকা ফেরত দিতে ১০ বছর সময় নেওয়া যাচ্ছে না। এ সময় খেলাপিঋণ আদায়ে এফবিসিসিআইয়ের সহযোগিতা চান তিনি। এবিবির সেক্রেটারি ও সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, ব্যাংকের যে মুনাফা পত্রিকায় আসে, তা প্রকৃত নয়। এর থেকে কর ও প্রভিশন বাদ দিতে হয়। আর ব্যাংক মুনাফা করতে না পারলে ঋণ দিতে পারবে না। ব্যাংক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। যে দেশে সব ঋণের সুদহার এক, সেখানে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার এটাও একটি কারণ। ঋণের খরচের ওপর নির্ভর করে সুদ ঠিক করা প্রয়োজন। এখন যেভাবে বিভিন্ন সেবা মাশুল নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে, তাতে ব্যাংক খাতের আয় ১২ থেকে ১৩ শতাংশ কমে আসবে। ওই সভায় এফবিসিসিআই পরিচালক আবু নাসের বলেন, খেলাপিঋণ বিশ্বব্যাপী সমস্যা। ব্যাংকগুলোর বাস্তবভিত্তিক গবেষণা নেই। একজন উদ্যোক্তার ঋণ পেতে সাত দফা অনুমোদন ও ৩৫টি তথ্য-প্রমাণাদি প্রয়োজন হয়। গ্রামের উদ্যোক্তাদের ঋণের জন্য ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ হয়ে যায়। প্রণোদনার ঋণের দীর্ঘসূত্রিতা থেকে মুক্তি চাই। ব্যবসায়ীদের বেদনার অবসান হোক। আরেক পরিচালক ড. নাদিয়া বিনতে আমিন বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য দেওয়া প্রতিশ্রুতির পূরণ হয়নি। আরেক পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, ‘করোনার ১৮ মাসে আমাদের ব্যবসায় অনেক খারাপ সময় গেছে। প্রণোদনা তহবিল থেকে যে ঋণ পাওয়া গেছে, সেই ঋণে ৩ বছর গ্রেস পিরিয়ড দিয়ে ১০-১৫ বছরে কিস্তিতে শোধ করার সুযোগ দিলে ভালো হয়।’ এর জবাবে ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়রা আজম বলেন, ‘আপনারা ঋণ পরিশোধে দীর্ঘমেয়াদি সময় চাইছেন। অথচ প্রণোদনার ঋণের মেয়াদ ১ বছর। ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময় চাইছেন, কিন্তু আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে বাড়তি সময় চাওয়া কি সম্ভব?’ রূপালী ব্যাংকের এমডি ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, খেলাপিঋণ আদায় নিয়ে এমন একটা সভার আয়োজন করতে পারে এফবিসিসিআই। এতে সব ব্যাংকের খুব উপকার হবে। ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআই পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, সময় এসেছে যারা খারাপ গ্রাহক, তাদের পাশে দাঁড়ানোর। তাদের সহায়তা করে ভালো গ্রাহকে পরিণত করার এখনই সময়। এ সময়ে ব্যাংকগুলো যদি মুনাফার চিন্তা করে, তাহলে চলবে না। এখন সময় টিকে থাকার, মুনাফা করার নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর