শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনা টেস্ট নিয়ে রমরমা ব্যবসা

কিটের দাম ১ হাজার, টেস্টের খরচ ৩ হাজার । সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, ভোগান্তি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

করোনাভাইরাস শনাক্তে আরটি-পিসিআর টেস্টে প্রয়োজনীয় কিটের দাম কমলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলো টেস্টের খরচ কমায়নি। কিটের দাম ২ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় নামলেও টেস্টের খরচ নেওয়া হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। সরকারি হাসপাতালে ১০০ টাকায় টেস্ট করানো গেলেও রয়েছে অব্যবস্থাপনা, ভোগান্তি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালগুলো ব্যবসায়িক মনোভাবে চলছে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবরেটরির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ মহামারীর মধ্যেও তারা বিবেক বিবেচনা ছাড়া টেস্টের মূল্য নির্ধারণ করছে। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি থেকে বারবার টেস্টের খরচ কমাতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা কাউকে মানে না। সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থাপনা অগোছালো হওয়ায় ভোগান্তি হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ কমাতে পরিকল্পনামাফিক জেলা, উপজেলা পর্যায়ে টেস্ট বাড়াতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ল্যাব সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু অগোছালোভাবে। যার যেখানে ইচ্ছা ল্যাব খুলছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো অনুযায়ী পরিকল্পনা করে ল্যাব খুলতে হবে। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাতে থাকতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শনাক্ত হয় করোনাভাইরাস। এরপর চীন থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন। তখন করোনা টেস্টের ব্যবস্থা শুধু সরকারি ল্যাবেই ছিল। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে সরকারি ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় টেস্টের অনুমোদন দেওয়া হয়। গত বছরের ২৯ এপ্রিল প্রথম তিনটি বেসরকারি হাসপাতালকে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা শনাক্তে নমুনা পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সময় পিসিআর কিটের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ভর্তি রোগীর নমুনা পরীক্ষার খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এরপর ২১ মে আরও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়। তাদের জন্যও নমুনা পরীক্ষার ফি ছিল সাড়ে ৩ হাজার টাকা। তবে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হলে সাড়ে ৪ হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তখন পিসিআর কিট সরবরাহে ঘাটতি ছিল। কিটের চাহিদাও ছিল আকাশচুম্বী। কিট সংকটে মাঝেমধ্যেই বন্ধ থাকত বিভিন্ন ল্যাব, পড়ে থাকত নমুনার স্তূপ। তখন একেকটি কিট ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত দামেও কিনতে হয়েছে।

এর প্রায় এক বছর পর এ বছরের ৬ মে নমুনা পরীক্ষার ফি কমিয়ে দেয় সরকার। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতাল বা কেন্দ্রে গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করালে ৩ হাজার এবং বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হলে ৩ হাজার ৭০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়। অথচ পিসিআর কিটের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় ওই সময় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তো বটেই, কভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটিও বেসরকারিতে এ পরীক্ষার ফি দেড় থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। গত বছরের শেষের দিকে কমতে থাকে কিটের দাম। কিটের সরবরাহ বাড়তে থাকায় বর্তমানে সে দাম কমতে কমতে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। এ বছরের মে মাসে সরকারিভাবে ট্যাক্সসহ ৯৮০ টাকা দরে সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপোতে (সিএমএসডি) কিট সরবরাহ করা হয়েছে। বেসরকারি ল্যাবগুলোয় ৯৬০-৯৭০ টাকায় কিট সরবরাহ করা হয়েছে। বর্তমানে সিএমএসডি থেকেই সরকারিভাবে কার্যাদেশের মাধ্যমে ৮৪০ টাকা দিয়ে কিট কেনা হচ্ছে। ৬৫০ টাকা-১ হাজার টাকার মধ্যে আরটি-পিসিআর কিটের দাম পড়লেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনা টেস্টের দাম রাখা হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে টেস্ট বাড়ানোয় জোর দেওয়া হয়েছে। জেলা-উপজেলায় আরটি-পিসিআর ল্যাব, জিন এক্সপার্ট, র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকারি পরীক্ষাগারের পাশাপাশি বেসরকারি পরীক্ষাগারেও চলছে টেস্ট। বেসরকারি হাসপাতাল ও কেন্দ্রে টেস্টের খরচ কমিয়ে সবার নাগালের মধ্যে আনার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। তাই বেসরকারি হাসপাতালে করোনা টেস্ট খরচ কমাতে গত সপ্তাহে একটি প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’

সরকারি হাসপাতাল ও কেন্দ্রগুলোয় ১০০ টাকা ফিতে করোনা টেস্ট করা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে রয়েছে দীর্ঘ লাইনের ভোগান্তি। কত জনের টেস্ট করানো হবে তা নির্ধারণ না থাকায় অনেক সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে। রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়ায় রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে, বাড়ছে সংক্রমণ ছড়ানোর শঙ্কা। রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে বুধবার গলা ব্যথা ও জ্বর নিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়েছিলেন নুর ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শরীরে প্রচ- জ্বর, গলা ব্যথা, গন্ধ পাচ্ছি না। কিছুটা শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। করোনার সব ধরনের উপসর্গ আছে। কিন্তু দুই দিন পার হলেও রিপোর্ট পাইনি। তাই কিছু নিশ্চিত না হওয়ায় সব ওষুধও শুরু করতে পারছি না।’

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে করোনা টেস্ট বাড়ানোর বিকল্প নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীর চাপ বেশি থাকায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। বেসরকারি হাসপাতালে খরচ বেশি হওয়ায় অনেকের সামর্থ্যে কুলায় না। এখন টেস্ট কিটের দাম কমেছে। তাই খরচেও সমতা আনা প্রয়োজন।’

সর্বশেষ খবর