সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

দেড় বছর পর ঘণ্টা শুনল শিক্ষার্থীরা

উৎসব-আমেজে মানা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি, রাজশাহী পিরোজপুরে গাছতলায় ক্লাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেড় বছর পর ঘণ্টা শুনল শিক্ষার্থীরা

রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুলে গতকাল স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষার্থীরা -জয়ীতা রায়

উৎসবমুখর পরিবেশে গতকাল সারা দেশে প্রথম দিনের ক্লাস করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গতকাল বাজল স্কুলের ঘণ্টা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ দেখা গেছে। নতুন বছরের মতোই আগ্রহভরে ক্লাসে এসেছিল তারা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছিল স্বাস্থ্যবিধি মানার কড়া নির্দেশনা। এই নির্দেশনা মেনেই স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় এসেছিল ছাত্র-ছাত্রীরা। শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল  প্রতিষ্ঠানগুলোও। ব্যান্ড বাজিয়ে, ফুল দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়া হয় স্কুলে স্কুলে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপন, শারীরিক দূরত্বের বিধি, হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম, মাস্ক পরার নিয়ম, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচারও টাঙানো হয়েছিল। তাপমাত্রা মেপে মেপে শিক্ষার্থীদের ভিতরে ঢোকাতে দেখা গেছে স্কুল-কলেজগুলোতে। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সারিবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীদের ভিতরে ঢোকানোর কাজ করেন স্কাউটের সদস্যরা। গতকাল রাজধানীর বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। স্কুল-কলেজ খোলার পর প্রথম দিনে গতকাল শ্রেণি-কার্যক্রম শুরুর সার্বিক প্রস্তুতি দেখতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং লেকসার্কাস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে যান। রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সেগুনবাগিচা আইডিয়াল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানে ঢোকার ক্ষেত্রে কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হচ্ছে ছাত্রীদের। ঢুকতেই জীবাণুনাশক স্প্রে ও তাপমাত্রা মেপে নিচ্ছেন স্কাউট সদস্য মালিহা আনজুমসহ অন্যরা। প্রবেশপথেই রয়েছে হাত ধোয়ার বেসিন। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে হাত ধোয়ার বেসিন। টাঙানো হয়েছে বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি। প্রতিষ্ঠানটির ১২৮ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস চলছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। এ ক্লাসের শিক্ষার্থী আফরিদা মৌ এ প্রতিবেদককে বলেন, দীর্ঘদিন পর ক্লাসে এসে অনেক ভালো লাগছে। ক্লাসে প্রতি বেঞ্চে একজন করে বসানো হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। প্রতিষ্ঠানের ৮০ ভাগ ছাত্রী প্রথম দিন ক্লাসে এসেছেন বলে জানান তিনি। প্রথম দিন গতকাল এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী, পঞ্চম শ্রেণি ও প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হয়েছে। মাউশির নির্দেশনা মেনে ক্লাস রুটিন প্রণয়নের কথা জানান তিনি। গত বছর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল তাসনিম মতিন। কিন্তু করোনার মহামারীর কারণে এক দিনও কলেজে আসতে পারেনি। গতকাল প্রথম কলেজে এসেছিল সে। এ যেন আলাদা এক অনুভূতি ছিল তার মধ্যে। তাসনিম জানায়, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে আজকেই (গতকাল) বান্ধবীদের সঙ্গে পরিচয় হলো।’ কলেজ-জীবনে প্রথম ক্লাস করে অনেক ভালো লাগার কথা জানায় সে। একই অনুভূতি ব্যক্ত করে তাসমিয়া সিদ্দিকী জাহিন ও ফারনাজ ফারিয়া। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ কানিজ মাহমুদা আকতার বলেন, সরকারের সব নির্দেশনা মেনে কলেজে পাঠদান চলছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও সন্তোষজনক। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো রাজধানীর ডেমরায় সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা কার্যক্রম চলেছে গতকাল। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, পর্যাপ্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, হাত ধোয়ার বেসিনসহ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর ক্লাসে ফিরতে পেরে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গেটে ঢুকতেই শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। এরপর তাদের ফুল-চকলেট দিয়ে বরণ করেন শিক্ষকরা।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জারি করা নির্দেশনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক নির্দেশনা অনুসরণ করে ‘কভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুর নির্দেশনা’ জারি করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজগুলোকে মানতে হচ্ছে এসব নির্দেশনা। স্টোররুম অপরিষ্কার দেখে অধ্যক্ষকে বরখাস্তের নির্দেশ দিলেন মন্ত্রী : স্কুল খোলার প্রথম দিন গতকাল আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি কক্ষ অপরিষ্কার দেখে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হাছিবুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সকালে এ স্কুলের পাঠদান কার্যক্রমের প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে তিনি এ নির্দেশ দেন। তবে মন্ত্রীর পরিদর্শন দলে থাকা মন্ত্রণালয় ও মাউশির একাধিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, যে কক্ষ মন্ত্রী অপরিষ্কার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সেটি ক্লাসরুম নয়, বরং স্টোররুম হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অভিযুক্ত অধ্যক্ষ হাছিবুর রহমান বলেন, ‘মন্ত্রী যখন পরিদর্শনে আসেন, তখন একটি স্টোররুমে গিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আমি তখন বলতে পারিনি যে এটা স্টোররুম।’ এদিকে স্টোররুম অপরিষ্কার পেয়ে অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দেওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্তের কথা বললেও তাকে কারণ দর্শাতে নোটিস দেবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর।

স্কুল-কলেজের ৯০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারী টিকা নিয়েছেন : মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেছেন, দেশের স্কুল-কলেজগুলোর ৯০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারী কভিড-১৯ টিকা নিয়েছেন। বাকিরা নানা কারণে নিতে পারেননি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শন শেষে গতকাল সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

গাছতলায় ক্লাস করল রাজশাহীর শিক্ষার্থীরা : রাজশাহী থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, স্কুলভবনের কাজ চলছে, তাই দেড় বছর পরও স্কুলে ফিরে শ্রেণিকক্ষে বসতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। ক্লাস করতে হয়েছে গাছতলায়। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিজ অঙ্গনের গাছতলায় ক্লাস করলেও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের যেতে হয়েছে পাশের আরেকটি বিদ্যালয়ে। ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহীর চারঘাট পৌর এলাকার পিরোজপুর-১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জানা গেছে, চারঘাটের পিরোজপুর এলাকার ওই বিদ্যালয়টি ছিল টিনশেডের। অফিস, স্টোররুম ও শ্রেণিকক্ষ মিলে মোট ৯টি কক্ষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে মাত্র দুটি, যার একটিতে দাফতরিকসহ শিক্ষকরা অন্যান্য কাজ করেন। অন্যটিতে করা হয়েছে স্টোররুম। এতে রাখা হয়েছে রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের মাঠে পড়ে আছে ইট, বালু ও মাটির স্তূপ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিদ্যালয়ের মোট ২৯২ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ৬০ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিল ৫০। তৃতীয় শ্রেণির ৮০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ জন উপস্থিত ছিল। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অনেক দিন পর স্কুল খুলেছে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে বসতে পারেনি। ক্লাস করেছে গাছতলায় ইটে বসে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুরাদ আলী বলেন, করোনার শুরুতে দোতলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। কথা ছিল ছয় মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। কিন্তু দেড় বছরের বেশি পার হলেও কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার ও শিক্ষা প্রকৌশল দফতর। তাই বাধ্য হয়েই গাছতলায় ক্লাস করাতে হয়েছে।

অভিভাবকদের জটলা প্রতিষ্ঠানের বাইরে : ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা গেলেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে অভিভাবকদের জটলা লক্ষ্য করা গেছে। তবে অভিভাবকদের সবাইকে মাস্ক পরতে দেখা গেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে অভিভাবক আরিফা সুলতানা বলেন, দীর্ঘ দেড় বছর পর শিশুরা স্কুলে ফিরতে পেরেছে। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কমপক্ষে সপ্তাহে এক দিন হলেও স্কুল খোলা রাখা হোক।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিরা জানান, খুলনার প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ছিল ৭০ শতাংশ। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ জুড়ে যেন ঈদের আমেজ। এ আনন্দের মধ্যেও মন খারাপ ছিল শিক্ষার্থীদের। গত দেড় বছরে তারা হারিয়েছেন কলেজের হেড ক্লার্ক শামছুজ্জামান, কর্মচারী জহিরুল হক খান, রতন ও বাসচালক খোকনকে। কলেজে এসে প্রিয় মুখগুলোকে দেখেননি তারা। একে অন্যের সঙ্গে তাদের নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন। সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে সরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করছেন শিক্ষকরা। কুড়িগ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় খুশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।

সকাল থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। গাজীপুরে সকালেই পরিপাটি স্কুলড্রেস পরা শিশুদের পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণ। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধিরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর