বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
দেড় বছর পর মাঠে গড়াল রাজনীতি

করণীয় নির্ধারণে সিরিজ বৈঠক করছে বিএনপি

মাহমুদ আজহার

করণীয় নির্ধারণে সিরিজ বৈঠক করছে বিএনপি

দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক কর্মকৌশল ঠিক করতে সিরিজ বৈঠক শুরু করছে বিএনপি। করোনার দেড় বছর পর নতুন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করল দলটি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে নিরপেক্ষ সরকার চায় বিএনপি। সেই লক্ষ্যে দলটি ডিসেম্বর মাসকে টার্গেট করে আন্দোলনের ছক তৈরি করতে নেতাদের মতামত নিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ৫০২ সদস্যের ‘ঢাউস’ কমিটির মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকদের পাশাপাশি অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক শুরু করছে।

গতকাল বিকাল পৌনে চারটায় ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা অংশ নেন।

জানা যায়, পরবর্তীতে ৮২টি সাংগঠনিক জেলার শীর্ষ নেতাদের ছাড়াও নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এরপর ২০-দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গেও বৈঠক করা হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে মতামত ও নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে তাদের মতামত নেওয়া হবে। এরপর নিরপেক্ষ নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হবে। পরবর্তীতে দাবিদাওয়া সংবলিত একটি বই আকারে প্রকাশ করে তা রাষ্ট্রপতিকেও পাঠাবে দলটি। সুযোগ পেলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও এ নিয়ে বসতে চায় দলটি। এরপর কোনো সুরাহা না হলে দাবি আদায়ে ডিসেম্বর থেকে আন্দোলন করার চিন্তাভাবনা আছে তাদের। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে নিরপেক্ষ সরকার থাকতে হবে। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন প্রমাণ করে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। এই অবস্থায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে করণীয় ঠিক করতে হবে। প্রয়োজন সবার মতামত নেওয়ার। তাছাড়া দেশজুড়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও চাঙা হবে। দীর্ঘদিন ধরে ঝিমিয়ে থাকা নেতা-কর্মীদের সক্রিয় করাও বিএনপির লক্ষ্য। সার্বিক বিবেচনায় দলকে গতিশীল ও আন্দোলনমুখী করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।  দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা জানান, দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মতামত নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার একটি খসড়া তৈরি করা হবে। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গেও একই প্রক্রিয়ায় বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সবার মতামতের পরই চূড়ান্ত করা হবে আন্দোলনের কৌশল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘ দেড় বছর ধরে করোনার কারণে বিএনপি সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরি চালাতে পারেনি। এখন বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় আমরা স্থগিত থাকা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের এখন সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা, গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। এসব দাবি আদায়ে আমাদের আন্দোলনের বিকল্প নেই। সবাইকে মনে রাখতে হবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে নিরপেক্ষ সরকার। সেই বিষয়ে আমরা দলের নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ বিশিষ্টজনদের সঙ্গেও কথা বলব। প্রয়োজনে আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও বৈঠক করে আমাদের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরব। 

ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে বিএনপির নীতি নির্ধারকদের বৈঠক : আগামী দিনে করণীয় নির্ধারণে মতামত জানতে গতকাল দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিকাল পৌনে চারটায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই বৈঠক শুরু হয়। প্রথম দিনের বৈঠকে ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিলে ৬২ জন অংশ নেন। তারেক রহমানের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠক সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির কী করণীয়, আন্দোলনের কর্মকৌশল কী হওয়া উচিত, আগামী নির্বাচন নিয়ে কী চিন্তা, মাঠ পর্যায়ের সংগঠনকে কীভাবে আরও সক্রিয় করা যায় ইত্যাদি বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা পর্যায়ের নেতারা বৈঠকে মতামত দেন। তারেক রহমানসহ বিএনপির নীতিনির্ধারকরা তাদের বক্তব্য শোনেন। প্রথমে উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন বক্তব্য দেন। পরে কয়েকজন ভাইস চেয়ারম্যান বক্তব্য দেন। বৈঠকে নেতাদের মতামত নোট আকারে লিপিবদ্ধ করেন বিএনপির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, মাহমুদুল হাসান, জয়নাল আবেদীন, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, শওকত মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া উপদেষ্টাদের মধ্যে মনিরুল হক চৌধুরী, মশিউর রহমান, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, হাবিবুর রহমান হাবিব, লুৎফর রহমান খান আজাদ, আবদুস সালাম, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, ফজলুর রহমান, শাহজাহান মিয়া, সুকোমল বড়ুয়া, খন্দকার মুক্তাদির আহমেদ, এস এম ফজলুল হক, আবদুল হাই, ভিপি জয়নাল আবেদীন, গোলাম আকবর খন্দকার, অধ্যাপক ড. শাহেদা রফিক, আফরোজা খানম রীতা, তাহসিনা রুশদীর লুনা, অধ্যাপক তাজমেরী এস ইসলাম, ইসমাইল জবিউল্লাহ, এরামুজ্জামান, তৈমুর আলম খন্দকার, মইনুল ইসলাম শান্ত, মাহবুবুর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, আবদুল হাই শিকদার, আতাউর রহমান ঢালী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যদের বৈঠকের পর রাত সাড়ে ৮টায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বৈঠকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দলের সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর বেশি কিছু এখন বলার নেই। আগামীকাল বুধবার (আজ) ও পরদিন বৃহস্পতিবার বৈঠকের পর বিস্তারিত গণমাধ্যমকে জানানো হবে। বৈঠক সূত্র জানায়, দুজন উপদেষ্টা ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধা ইস্যুতে বিএনপির স্পষ্ট অবস্থান জানতে চান। এ সময় তারা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, জামায়াত ২০-দলীয় জোটের শরিক হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাই তাদের সঙ্গে না থাকাই ভালো। তারপরও এ ব্যাপারে দলের অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত। একাধিক ভাইস চেয়ারম্যান সরকারবিরোধী বৃহত্তর জোট সম্প্রসারণ করার কথাও বলেন।

জানা যায়, বৈঠকে অধিকাংশ নেতাই খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আন্দোলনের পক্ষে মত দেন। তারা বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। নিরপেক্ষ ব্যক্তি নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। কেউ কেউ দলের অঙ্গসংগঠনগুলো বিশেষ করে যুব দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, ছাত্রদলকে আন্দোলনমুখী নেতৃত্বে পুনর্গঠনের কথা বলেন।

নির্বাহী কমিটিতে ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে সদস্য সংখ্যা ৭৪ জন। বিএনপির দফতর শাখা জানায়, আজ বুধবার দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদক ও সহ সম্পাদকরা থাকবেন। এরপর বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বসবেন তারেক রহমান।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার আগে ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর