রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
নিউইয়র্কে সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী

বিদেশে বসে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণে কিছু লোক

♦ জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ও ছেলে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ♦ জয়ী হওয়ার শক্তি ও সাহস থাকলে বিএনপি নির্বাচনে আসবে ♦ ঝুঁকি নিয়ে টিকার সর্বজনীন করার কথা বলেছি

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

বিদেশে বসে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণে কিছু লোক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছু লোক বিদেশে অবস্থান করে দেশের সমালোচনা করে এবং ভাবমূর্তি নষ্ট করে। আমরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশকে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে উন্নীত করেছি। এখন তাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা।

শুক্রবার (২৪ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। নাগরিক সংবর্ধনা শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন। নিউইয়র্ক আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো এ সংবর্ধনার আয়োজন করে।

হোটেল থেকে ভার্চুয়ালে প্রবাসীদের সংবর্ধনা সমাবেশে শেখ হাসিনা টানা ৬২ মিনিটের বক্তব্যে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিবৃত করেন। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি মহিমান্বিত করতে কীভাবে তিনি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন তা-ও ব্যক্ত করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কিছু লোক আওয়ামী লীগ সরকারকে অবৈধ বলে অভিহিত করছে। আমার প্রশ্ন হলো, কী করে তারা এ শব্দগুলো উচ্চারণ করার সুযোগ পায়? আমরা বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তুলেছি বলেই তারা এটা বলার সুযোগ পেয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের কাছ থেকে সরকারের সমালোচনাকারীরা অর্থ গ্রহণ করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি তারা নীতিমান হয় এবং তাদের কোনো আদর্শ থাকে তাহলে তারা আমাদের তৈরি ডিজিটাল সিস্টেমগুলো কেন ব্যবহার করে? সরকারপ্রধান বলেন, হাই কোর্ট জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ সরকারকে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কারণ তারা সামরিক আইন জারি করে তাদের সরকার গঠন করেছিল।

শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমানের স্ত্রী এতিমদের অর্থ আত্মসাতের জন্য সাজাপ্রাপ্ত এবং তার ছেলে (তারেক রহমান) ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এমনকি তাদের দুর্নীতির তথ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনও (এফবিআই) প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, বিএনপি দেশের মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে এত বেশি অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছে যে তারা একজন এফবিআইর লোককে নিয়োগ করেছিল, যা পরে এফবিআই প্রকাশ করে। জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জয়ের শক্তি এবং সাহস থাকলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে।

বিএনপির শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সব রাজনৈতিক দল সে নির্বাচন বর্জন করে এবং জনগণ তাদের ভোট দেয়নি। যেহেতু জনগণ তাদের ভোট দেয়নি তাই তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তিনি বলেন, মা-বাবা-ভাই-ভাবিসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করার পর ’৮১ সালে যখন বাংলাদেশে ফিরেছি তখন জীবন হাতে নিয়েই ফিরেছি। আমি জানি যে ওরা আমাকেও সুযোগ পেলেই শেষ করে দেবে। ন্যায় আর সত্যের জন্য যখন কথা বলব স্বাভাবিকভাবেই জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হবে। সেজন্য সত্য বলব না, ন্যায়সংগত কথা বলব না, এটা তো হয় না। তাই আমি বলে যাচ্ছি। অনেক হুমকি এসেছে, জেলেও যেতে হয়েছে, তবু আমি থামিনি। তিনি বলেন, কাউকে না কাউকে তো ঝুঁকি নিতেই হবে। যারা অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত অবশ্যই তাদের জন্য কাউকে না কাউকে ঝুঁকি নিতে হবে। আমার তো হারাবার কিছু নেই। সবই তো হারিয়েছি। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই। তিনি বলেন, করোনার ভ্যাকসিন অনেক দেশ পাচ্ছে না। সবারই অধিকার রয়েছে টিকা পাওয়ার। তাই আমি ঝুঁকি নিয়েই টিকা সর্বজনীন করার কথা বলেছি। গণমাধ্যমের কাছে কোনো প্রত্যাশা আছে কি না জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা তো সবকিছু খুলে দিয়েছি। তাই পত্রিকাগুলো অপবাদ ছাড়া গঠনমূলক সাংবাদিকতা করতে পারে। দেশের জন্য যা ভালো তা করবে না এটা তো হতে পারে না। যা মানবিক তা করবে না এটা তো হতে পারে না। তাই দায়িত্বশীলতা সব দিক থেকে সমানভাবে হওয়া দরকার। তিনি বলেন, আগে তো একটি বিটিভি ছিল, রেডিও ছিল। এখন তো আমরা ব্যাপকভাবে খুলে দিয়েছি। তাই বলারও অবাধ সুযোগ, লেখারও অনেক সুযোগ। শুধু একটি কথা বলব, মানুষের জন্য যেটি কল্যাণকর সেটি করা দরকার। সেদিকে আপনারা (সাংবাদিকরা) খেয়াল রাখবেন। সমালোচনা করবেন, তবে সেখানে যাতে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।

শেখ হাসিনা প্রবাসীদের প্রতি আহ্‌বান জানিয়ে বলেন, যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি আর কল্যাণ চায় না তারাই বিদেশে বসে সংঘবদ্ধভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এহেন অবস্থার বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে। গত ১২ বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ধারাবিবরণী, মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ঘটনাবলি বেশি করে প্রচার করতে হবে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে কাজ করে। আর বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে হরিলুট চালিয়েছে। এতিমের টাকা মেরেও খেয়েছে। তিনি বলেন, করোনার চিকিৎসাসামগ্রীর জন্য অনেক প্রবাসী মার্কিন প্রশাসনে দেনদরবার করেছেন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের দেশে বিনিয়োগের আহ্‌বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমি একটা কথা বলব- আমাদের প্রবাসী যারা তারা কিন্তু বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগ করতে পারেন। শুধু আমেরিকাই করবে তা না, আমাদের প্রবাসী আমেরিকানরা যত দূর পারেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুন। বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে সরকার বাংলাদেশে যে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা করে দিচ্ছে তা প্রবাসীদের জানান প্রধানমন্ত্রী। সারা দেশে ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথাও তিনি বলেন। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা সচল রাখতে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপও প্রবাসীদের সামনে তুলে ধরেন তিনি।

সেই ট্রাঙ্কগুলো রাখলাম কোথায়, সেই খোঁজটা তারা দিক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি শুনলাম কেউ কেউ বলেছে আমি নাকি কত বস্তা, না কত ট্রাঙ্ক বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে বিমানে এসেছি। যারা এ কথাগুলো বলেছে তারা যখন এ বিষয়টা জানে তো সেই ট্রাঙ্কগুলো গেল কোথায়, রাখলাম কোথায়, কী হলো? সেই খোঁজটা তারা একটু দিক। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে দেড় শ সুটকেস নিয়ে সৌদি আরব চলে গিয়েছিল এবং সেখানে লকার ভাড়া করে নাকি অনেক জিনিস রেখে এসেছিল শোনা যায়। তখন সেটা প্রচার হয়েছিল। আর খালেদা জিয়ার মন্ত্রী বাবর (লুৎফুজ্জামান বাবর) যখন এখানে আসে, এয়ারপোর্টে ধরা পড়েছিল কয়েক লাখ ডলার নিয়ে। পরে অ্যাম্বাসি থেকে লোক গিয়ে কোনোমতে মুচলেকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়েছিল।

সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, যাদের এসব বদভ্যাস তারা সবাইকে, মানে নিজে চোর, সবাইকে ওই রকমই মনে করে। এটা হলো তাদের চরিত্র। এ ধরনের কথা তারা ছড়ায়, মনে করে যে এটা বোধহয় খুব প্রচার করতে পারবে। সমালোচনাকারীরা একটা কথা ভুলে যায় যে আমি জাতির পিতার মেয়ে। আমরা দেশের জন্য কাজ করি, আর ক্ষমতাটা আমাদের কাছে দেশের সেবা করা, মানুষের সেবা করা। আমরা অর্থসম্পদের জন্য লালায়িত না। তিনি আরও বলেন, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তাদের সন্তানরা ক্ষমতাটাকে ভোগের জায়গা বানিয়েছে। ক্ষমতাটাকে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ার জায়গা বানিয়েছে। আর আমাদের কাছে ক্ষমতা হচ্ছে মানুষের ভাগ্য গড়া, বাঙালির ভাগ্য গড়া, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য গড়া। করোনাভাইরাস মহামারীকালে এ সফরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের চার্টার ফ্লাইট ব্যবহার করার ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ড্রিমলাইনার, সেটা নিয়েই আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। কেন এসেছি? দুটো কারণ। একটা হচ্ছে যে আমি যদি এ করোনার সময় অন্য এয়ারলাইনসের টিকিট করি তাহলে তাদের টাকা দিতে হয়। আর আপনারা জানেন আন্তর্জাতিক রুটগুলো করোনার কারণে বন্ধ ছিল। আমাদের বিমানগুলো বসেই ছিল। আর একটা বিমান বসে থাকলে তার রক্ষণাবেক্ষণে একটা বিরাট টাকা খরচ হয়। সেজন্যই আমি বললাম, আমরা অন্য এয়ারলাইনসকে টাকা না দিয়ে আমাদের বিমান নিয়ে আসব। কারণ ওরা তো দেশে বসে আছে। কাজেই আমাদের সঙ্গে এলো আর ঘরের টাকা ঘরেই থাকল, বিমানই পেল।

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে নিউইয়র্কে বিমানের ফ্লাইট পুনরায় চালুর কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী, আমাদের লক্ষ্য নিউইয়র্কে অন্তত আমাদের নিজেদের বিমান আসবে। সেটাও আমরা আনতে চাই। জেএফকেতে (জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) ল্যান্ডিং করার প্র্যাকটিসটাও হয়ে গেল। ভবিষ্যতে তো আসব। কাজেই তার প্র্যাকটিসটা এখান থেকেই করে গেলাম। বিমানের অবস্থা একসময় ‘ঝরঝরে’ ছিল মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি আমলে বিমানের সীমাহীন দুর্নীতি ছিল। এ পর্যন্ত প্রায় ১১টি বিমান আমরা কিনেছি, আজকে আমাদের ২১টি বিমান। এ সংবর্ধনা সমাবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বিবদমান গ্রুপগুলো নিজ নিজ পছন্দের ভেন্যু ভাড়া করেছিল। সবকিছুর নিরসন ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপের মধ্যস্থতায়। অবশেষে সংগঠনের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের ভাড়া করা মিলনায়তনেই সমাবেশ হয়। অন্য গ্রুপগুলোর নেতা-কর্মীরাও এসেছিলেন। হোটেল থেকে এ সংবর্ধনা সমাবেশের সঞ্চালনা করেন আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি। স্বাগত বক্তব্য দেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের নেতা হিসেবে ১৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে আসেন শেখ হাসিনা। ২৫ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল ৮টায় (বাংলাদেশ সময় শনিবার সন্ধ্যা ৬টা) ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশে তিনি বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে জেএফকে এয়ারপোর্ট ত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁর ওয়াশিংটনে অবস্থানের কথা।

সর্বশেষ খবর