মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

তথ্য পেতে ভোগান্তি-অনিশ্চয়তা

তথ্য অধিকার দিবস আজ

জিন্নাতুন নূর

তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের এক যুগ পার হলেও তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে এখনো পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে, থাকতে হচ্ছে অনিশ্চয়তায়। বেশ কয়েকটি জরিপ ও গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, দেশের মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ তথ্য অধিকার সম্পর্কে জানেন। আবার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। অভিযোগ আছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মকর্তারা আবেদনকারীকে তথ্য দিতে গড়িমসি করেন। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে সহযোগিতাও করা হয় না। সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমকর্মীদেরও এ ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তথ্য আমার অধিকার, জানা আছে কি সবার’। এ উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘সরকার তথ্য কমিশনে যাদের নিয়োগ দিচ্ছে তারা তথ্য মুক্ত করার পরিবর্তে সরকারের অনুগত হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। এই কর্মকর্তারা মনে করেন, নাগরিকদের তথ্য দিলে সরকার অসন্তুষ্ট হবে। এ জন্য মানুষ এই তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। এটি এমন একটি আইন, যা জনগণ সরকার বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে পারবে। এ জন্য এ আইন জনগণকে জানতে হবে। জনগণকে এ আইন সম্পর্কে জানাতে হলে আরও প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে।’ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই) ও বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের ৯২ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে জানেন না। আর তরুণদের ওপর পরিচালিত অন্য এক জরিপে জানা যায়, দেশের ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ এ আইন সম্পর্কে জানেন না। অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৯ সালে আয়োজিত ‘তথ্য অধিকার আইন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ : আইনের প্রথম দশকের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক সভায় প্রকাশিত এক জরিপ অনুসারে ৭৫ শতাংশ মানুষ এ আইন সম্পর্কে জানে না। মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ তথ্য অধিকার সম্পর্কে জানলেও তাদের মধ্যে ২০ শতাংশের এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। চলতি বছর আগস্টে প্রকাশিত টিআইবির ‘তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ চর্চার মূল্যায়ন’ শীর্ষক অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্বতঃপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। তথ্যের ব্যাপ্তি ও উপযোগিতার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানেই আরও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটগুলোতে অনেক তথ্য প্রকাশিত হলেও হালনাগাদ তথ্য ও ধরন অনুযায়ী তথ্যের বিন্যাস ও সহজে তথ্যপ্রাপ্তিতে এখনো ঘাটতি আছে। আবার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশে অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম উদ্বেগজনক। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য পেতে হলে একজনকে নির্ধারিত ফরমে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর তথ্য চেয়ে আবেদন করতে হবে। একটিমাত্র তথ্য প্রদানকারী ইউনিট হলে অনধিক ২০ কার্যদিবস এবং একাধিক ইউনিট জড়িত থাকলে অনধিক ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য দিতে হবে। আর ব্যক্তির জীবন, মৃত্যু, গ্রেফতার বা কারাগার থেকে মুক্তি সম্পর্কিত হলে অনুরোধপ্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক তথ্য সরবরাহ করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আর তথ্য দেওয়া সম্ভব না হলে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে আবেদনকারীকে জানতে দিতে হবে। সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণ মানুষ খুব বেশি আইন সম্পর্কে জানেন না। দেশে সাড়ে এগারো শ আইন আছে, এর সব তাদের জানার প্রয়োজনও পড়ে না। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ একটু ভিন্ন প্রকৃতির। একে জনমুখী আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। আর জনগণ এটি জানতে পারলে সব প্রতিষ্ঠানে তা প্রয়োগ করতে পারবেন। তথ্যপ্রাপ্তির পর তা নিজেদের জীবনে কাজে লাগাতে পারবেন। কোন প্রতিষ্ঠান কী ধরনের সেবা দেয় তা জানা জনগণের অধিকার। আর জনগণ এগুলো যত বেশি জানবেন আমাদের প্রশাসন ও শাসনব্যবস্থা তত স্বচ্ছ ও জবাবদিহির মধ্যে থাকবে। দুর্নীতি কমে যাবে। তথ্য কমিশনার সুরাইয়া বেগম এনডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জনগণকে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সচেতন করার কাজ সবচেয়ে বেশি গণমাধ্যম করতে পারে। জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ উপজেলা পর্যায়ে জনঅবহিতকরণ সভা হচ্ছে। এ জন্য তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ইউএনও পর্যায়ে আমাদের বাস্তবায়ন কমিটি আছে। এখানে সব সেক্টরের প্রতিনিধিরা আছেন। এদের মাধ্যমে তথ্য প্রাপ্তির বিষয়টি আরও বেশি গ্রামীণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তথ্য আইনে তথ্য সহজে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার নাগরিকদের দাবি এখনো আন্দোলনে রূপ না নেওয়া দুর্ভাগ্যজনক। ভারতে সুশীল সমাজের উদ্যোগে এটি আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সহজে তথ্যপ্রাপ্তির জন্য আমরা তথ্য আইন পাস হওয়ার আগে থেকেই চেষ্টা করছিলাম। এ জন্য সরকারকে তথ্য কমিশনে সঠিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। নাগরিকদেরও এ জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এটি একমাত্র আইন, যার বাস্তবায়ন নির্ভর করে নাগরিকদের সক্রিয়তার ওপর।

সর্বশেষ খবর