শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা
আসামি পালানোর তদন্ত প্রতিবেদন

কারারক্ষীর গাফিলতির কারণেই বন্দী পালায়

উবায়দুল্লাহ বাদল

কারারক্ষীর গাফিলতির কারণেই বন্দী পালায়

করোনা মহামারীর কারণে কারাগারের নিরাপত্তামূলক তদারকিতে ঘাটতির সুযোগে গত বছরের ৬ আগস্ট গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আবু বক্কর ছিদ্দিক (৩৪) নামের এক কয়েদি পালিয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা সিসিটিভি ক্যামেরা যথাযথ মনিটরিং করেননি। এমনকি তদারকির জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়িত্বও দেওয়া ছিল না। ফলে কারাগারের নিরাপত্তায় প্রযুক্তিগত সব আধুনিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এর সঠিক ব্যবহার হয়নি। কয়েদি পালানোর ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কারাগারের তৎকালীন জেলার মোহাম্মদ বাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

অভিযুক্তের বক্তব্য, অন্যান্য ৩৪ সাক্ষীর বক্তব্য, জেল কোড ও ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত বোর্ড প্রতিবেদন তৈরি করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব নাসরিন জাহানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গত ২৮, ২৯ ও ৩০ আগস্ট সংশ্লিষ্ট কারাগার পরিদর্শনে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করেন। সম্প্রতি সুরক্ষা সেবা বিভাগে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। এখন প্রতিবেদনের আলোকে জেলার বাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে অভিযুক্ত জেলার (বর্তমানে পার্বত্য রাঙামাটি জেলা কারাগারের জেলার) বাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে মোট ৬টি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ৫টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এর ফলে তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন কারা অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অভিযুক্ত বাহারুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওই ঘটনাটি ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কোনো পরিকল্পিত ঘটনা নয়। এর জন্য ওই সময় দায়িত্ব পালনকারী ১২ জন বরখাস্ত হয়েছেন। আমিসহ অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে। আমরা নিজেরা তো বন্দী পাহারা দেই না। বন্দী পাহারা দেওয়া আমার কাজও নয়। কয়েদির তুলনায় কারারক্ষী অপ্রতুল। তাদের দিয়েই আমাদের কাজ চালাতে হয়। এখন তাদের দায়িত্ব অবহেলার জন্য আমাকে ‘বলির পাঁঠা’ হতে হচ্ছে। আশা করি ন্যায়বিচার পাব।’ বাহারুল ইসলামকে দায়ী করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারা নিরাপত্তায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব বাহারুল ইসলাম যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তার এই ব্যর্থতার কারণে কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক মই কাঁধে করে ব্রহ্মপুত্র ভবন থেকে প্রায় ৩০০ গজ পথ পাড়ি দিয়ে পেরিমিটার ওয়াল পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হন। পরে মইয়ের সাহায্যে পেরিমিটার ওয়াল টপকিয়ে আরপি গেটের মধ্য দিয়ে পালান। তার (জেলার) প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়া, সার্ভার রুমে ২/৩ জন কর্মচারীকে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব না দেওয়া এবং প্রযুক্তির সুফল প্রাপ্তির লক্ষ্যে যথাযথ সচেতনতা ও তদারকি না থাকায় কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক কারাগার থেবে পালাতে সক্ষম হন। পাশাপাশি বাহারুল তার অধস্তনদের সঠিকভাবে পরিচালনা করতেও ব্যর্থ হওয়ায় অধস্তনরা দায়িত্ব পালনে চরম শৈথিল্য দেখায়। এ সুযোগে বিনা বাধায় প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েদি কারাগার থেকে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া তিনি  দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হলে বন্দী পালানোর সহায়ক উপকরণ মই এবং কয়েদি পোশাকহীনভাবে কারাগারের ভিতর থাকতে পারত না। কয়েদি পালানোর সময় গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপারের দায়িত্বে ছিলেন জাহানারা বেগম। বর্তমানে তিনি কারা অধিদফতরে সংযুক্ত রয়েছেন। তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা হয়েছে; যা চলমান। তিনি কমিটির কাছে বলেছেন, ‘জেলখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেলার। সব স্টাফ সরাসরি জেলারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকেন। স্টাফ দেখভালসহ কাজ আদায় করে নেওয়ার দায়িত্ব জেলারের। জেলখানার ভিতর বন্দী পালানোর কোনো উপকরণ আছে কি না, নিষিদ্ধ দ্রব্য কোনো বন্দীর কাছে আছে কি না তা অপসারণ করা জেলারসহ তার অধস্তনদের দায়িত্ব। যা জেল কোডে জেলার অধ্যায়ে দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আসামি আবু বক্কর ছিদ্দিকের পলায়নের ঘটনায় জেলার, ডেপুটি জেলার, কারারক্ষীসহ দায়িত্বরত সবাই দায়ী। কর্তব্যরতরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটত না। দায়িত্বরত সবারই কর্তব্যে অবহেলা ছিল। ফলে কর্তব্যরত কেউই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।’ গত বছরের ৬ আগস্ট গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক পালিয়ে যান। এ ঘটনায় প্রধান কারারক্ষীসহ ১২ জন কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার আবাদ চ-ীপুর এলাকার তেছের আলী গাইনের ছেলে আবু বক্কর ছিদ্দিক ২০১১ সালের ১৪ জুন থেকে এ কারাগারে বন্দী ছিলেন। শ্যামনগর থানার একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির দন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুরের এ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ২০০২ সালের ১৭ মার্চ এর একটি হত্যা মামলায় (নম্বর-১২) আদালত আবু বক্করকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরের আদেশ দেয় ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট। পরবর্তীতে আসামির আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০১২ সালের ২৭ জুলাই ওই সাজা সংশোধন করে তাকে যাবজ্জীবন (৩০ বছর) সশ্রম কারাদন্ড দেয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর