সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

দুর্যোগে নিয়োগে মহাকেলেঙ্কারি

দুই সংস্থার ৩৫৩ পদের নিয়োগ তদন্তে দুই কমিটি । জড়িতদের কোনো ছাড় নয় : দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী

উবায়দুল্লাহ বাদল

লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়নি। অথচ চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য এমন একাধিক প্রার্থীকে সুপারিশ করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ১০৮টি পদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমন তুঘলকি কান্ড ঘটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। গত ৩ অক্টোবর দুদকের সহকারী পরিচালক জাবেদ হাবীবের নেতৃত্বে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম সিপিপির অফিসে এ বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করেছে।

একইভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অপর প্রতিষ্ঠান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের ১৪০টি অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ব্রিজ-কালভার্ট প্রকল্পের ১০৫ আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগেও বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সূত্রের দাবি, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদের পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁস এবং আউটসোর্সিংয়ে জনবল নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। এসব বিষয় আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গত ৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এসব নিয়োগের বিষয়ে তদন্ত করতে কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান করে উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থাৎ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুই দফতরের মোট ৩৫৩টি পদের নিয়োগ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।

এসব ঘটনায় প্রচ- ক্ষুব্ধ এবং বিব্রত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঘটনাটি আমরা জেনেছি। এটা কী করে সম্ভব! নিয়োগের সব পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে কী করে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেল। ইতিমধ্যে নিয়োগ স্থগিত করে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের নিয়োগেও জাল-জালিয়াতির অভিযোগে ১৪ জনকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। এসব অনিয়ম তদন্ত করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া  হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৮ আগস্ট সিপিপির ১৮ ক্যাটাগরির ১০৮টি শূন্য পদে নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ আগস্ট জুনিয়র সহকারী পরিচালক ক্যাটাগরির ১১টি পদে পরীক্ষা দেওয়া ৫ হাজার একজন পরীক্ষার্থীর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। এরপর ৪, ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর পর্যায়ক্রমে তাদের সবার মৌখিক পরীক্ষাও হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সিপিপির চূড়ান্ত ফলাফলে জুনিয়র সহকারী পরিচালক পদে অনেকের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন সাবাহ বিন হোসাইন। একইভাবে সহকারী কাম রেডিও অপারেটর পদে নিয়োগের সুপারিশ পান মো. সুমন। এ দুজন লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেননি। তারপরও তারা নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন। এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অনেকের নিকটাত্মীয়ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তারা বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) লিখিত অভিযোগ দেন। এরপরই সিপিপির ওয়েবসাইট থেকে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়। বিষয়টি আমলে নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ মো. মনিরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের ১৪০টি অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগের বিষয়েও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যাতে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন না উঠে সে কারণে প্রার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষার খাতার সঙ্গে প্রশ্নপত্রও নিয়ে নেওয়া হয়। ফলে ওই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কারও কাছে থাকার কথা নয়। অভিযোগকারীদের দাবি, পরীক্ষার আগেই কিছু প্রার্থীকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নপত্র পাওয়া প্রার্থীরা ৭০ নম্বরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬৫ থেকে ৬৮ নম্বর পেয়েছেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের একটি কপি বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছেও রয়েছে। কোনো একটি বাসায় বিছানার চাদরের ওপর তোলা ওই প্রশ্নপত্রে কোনো দাগের চিহ্নও নেই। অর্থাৎ পরীক্ষার আগে পাওয়া প্রশ্নপত্র। কারণ, সাধারণত পরীক্ষার পরের প্রশ্নপত্রে পেনসিল/কলমের নানা ধরনের দাগ বা টিক টিহ্ন থাকে; যা প্রার্থী নিজেই দিয়ে থাকে।

অন্যদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের ‘গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে ১০৫ কার্যসহকারী নিয়োগ করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, এ নিয়োগেও প্রার্থীদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৫ লাখ পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ওই নিয়োগের দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে প্রাপ্ত দরপত্র, দরপত্র মূল্যায়ন ও অনুমোদন, নিয়োগ প্রদান পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কাগজের সত্যায়িত কপি এবং এ সংক্রান্ত তথ্যাদিসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আতিকুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে। এসব লোক দিয়েছে কোম্পানি। তারা কারও কাছে টাকা নিয়ে থাকলে আমাদের কী করার আছে? এ নিয়োগ দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক, আমরা শুধু অনুমোদন দিয়েছি। আর ১৪০টি অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগের বিষয়ে কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস বা অনৈতিক লেনদেন হয়নি। সর্বোচ্চ ফেয়ার পরীক্ষা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ওইদিন ১২-১৪ জনকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। তারপরও বলব এসব অভিযোগ সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তদন্ত করতেই পারে। আমি আমার অবস্থান থেকে এ তদন্তকে স্বাগত জানাই।

সংসদীয় কমিটির তদন্ত কমিটি : এদিকে লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)-এর শূন্য পদে নিয়োগের সুপারিশে স্তম্ভিত সংসদীয় কমিটি। এ ঘটনা কীভাবে ঘটেছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে কমিটি মন্ত্রণালয়ের কাছে দ্রুত প্রতিবেদন চেয়েছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত ৩ অক্টোবর সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ প্রতিবেদন চাওয়া হয়। বৈঠকে কমিটির সদস্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, মজিবুর রহমান চৌধুরী ও জুয়েল আরেং অংশ নেন। বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, অনিয়ম-জালিয়াতির অভিযোগ ওঠায় মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, যারা চাকরির জন্য আবেদনই করেনি, আবেদন করলেও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি, আবার লিখিত পরীক্ষা না দিয়েই সরাসরি মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করেছে। আমরা তদন্ত রিপোর্টটি চেয়েছি। কম্পিউটার অপারেটরসহ বিভিন্ন পদে ডিজি লোক নিয়োগ দিয়েছেন, তাতে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয় তদন্ত করতে একটি উপ-কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও তদন্ত কমিটির প্রধান লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির মৌখিক নির্দেশে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। এখনো অফিশিয়াল অর্ডার হয়নি। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর