সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা
পারমাণবিক বিদ্যুৎ যুগে বাংলাদেশ

পরমাণু শক্তি শান্তির জন্য ব্যবহার করছি : প্রধানমন্ত্রী

পাবনা প্রতিনিধি

পরমাণু শক্তি শান্তির জন্য ব্যবহার করছি : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে পরমাণু চুল্লিপাত্র স্থাপনের উদ্বোধন করেন -পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পরমাণু শক্তি আমরা শান্তির জন্য ব্যবহার করছি। এই শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমরা  দেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করছি। তিনি বলেন, এই প্রকল্প শেষ হলে দক্ষিণাঞ্চলে আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ  কেন্দ্র তৈরি করব। আমরা জায়গা খুঁজছি।

গতকাল গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র স্থাপনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল হলো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এর ভিতরেই ইউরেনিয়াম থেকে শক্তি উৎপাদন হবে, যা কাজে লাগিয়ে তৈরি হবে বিদ্যুৎ। রিঅ্যাক্টই হলো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রাণ। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের মতে, রিঅ্যাক্টর স্থাপনের পর প্রকল্পের কাজ শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। প্রথম ইউনিটের ৫০ শতাংশ কাজ এ বছরই শেষ হবে।

সরকার আশা করছে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে রূপপুরের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা যাবে। সব ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা সম্ভব হবে।

রূপপুরের কাজ শেষ হলে আরও  একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দক্ষিণাঞ্চলে জায়গা খুঁজছি। দক্ষিণাঞ্চলে শক্ত মাটিওয়ালা জায়গা পাওয়া খুব কঠিন। তারপরও বিভিন্ন জায়গায় আমরা সার্ভে করছি, যে আরেকটা পাওয়ার প্লান্ট আমরা করব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব জিয়াউল হাসান স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রকল্প পরিচালক ও পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মো. শওকত আকবর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের সময় আরএনপিপি থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হন। অনুষ্ঠানে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়। পারমাণবিক প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা-ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক অ্যানার্জি অ্যাসোসিয়েশন (আইএইএ)-এর গাইডলাইন অনুযায়ী এবং সংস্থাটির কড়া নজরদারির মধ্য দিয়েই রূপপুর প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প (আরএনপিপি) বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, এ দিনটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আমার ব্যক্তিগত জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ। আমি খুব আনন্দিত হতাম যদি স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে পারতাম। করোনা মহামারীর কারণে সেটি সম্ভব হলো না। তবে দ্রুতই আমি এখানে আসব। তিনি বলেন, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গেও পাকিস্তান আমলের বঞ্চনার ইতিহাস জড়িত। তারা ধোঁকাবাজি করেছে শুধু জমি বরাদ্দ করে। প্রকল্পটি তারা পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়। তিনি বলেন, জাতির পিতা স্বাধীনতার পরপরই আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। ফলে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি-আইএইএ’র অনেক নির্দেশনা মেনে চলতে হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৩ সালে রাশিয়া সফরের সময় সে দেশের  প্রেসিডেন্ট মি. পুতিনের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। বিশেষ করে পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জননিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই আমরা এই প্রকল্প শুরু করি। তিনি বলেন, রিঅ্যাক্টর  প্রেসার ভেসেল স্থাপনের ফলে বিশ্বে পারমাণবিক যুগে বেশ শক্ত অবস্থানে এলাম আমরা। আর সেটি কিন্তু আমরা পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করে। তিনি বলেন, এই পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরাও নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। সবকিছু ভালোভাবে পরিচালনা করতে আমরা তাদের রাশিয়া ও ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, অনুষ্ঠানে  শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশকে যেন আর কখনো পিছিয়ে পড়তে না হয়। এ দেশের ওপর আর কখনো যেন কোনো শকুনির থাবা না পড়ে। সে জন্য সরকার বাংলাদেশকে ‘উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ’ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এখন যদি আমরা আরেকটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট করতে পারি, তাহলে বিদ্যুতের জন্য আর কোনো অসুবিধা আমাদের হবে না। তারপরও আমরা বহুমুখী বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছি এই জন্য যে বিদ্যুৎ সুবিধাটা মানুষ যেন পায়, এটা যেন অব্যাহত থাকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে এ বছর। একই সময়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ২০১৩ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও কথা হয়েছিল। সেখানে আমার কতগুলো প্রশ্ন ছিল, আমরা এটা করার পর এটার নিরাপত্তা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। কারণ বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। আমাদের যে চুক্তি হয়, তাতে এটাও নিশ্চিত করা হয়, এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সব সময় রাশিয়াই করবে। সেই বিষয়গুলো আমরা নিশ্চিত করি। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বাংলাদেশে একটা কিছু করতে গেলে এত সমালোচনা, এত সমালোচনা হয়। নানাভাবে নানা জনে, কেউ বুঝে না বুঝে অনেক কথা বলে ফেলে, অনেক কথা লিখে ফেলে। টকশোতে অনেক কথা, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের নিয়ম। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ফলে বাংলাদেশের নিজস্ব দক্ষ জনবলও তৈরি হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে যারা বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী বা যারা নিউক্লিয়ার বিষয়ে কাজ করেন, সবারই কিন্তু একটা অভিজ্ঞতা হলো। তাদের ট্রেনিং করাতে হচ্ছে। তাদের রাশিয়া ও ইন্ডিয়াতে ট্রেনিং করাচ্ছি।

সরকারপ্রধান বলেন, আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। কিন্তু এখানে থেমে গেলে চলবে না। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ আমরা করব। ২০৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন হবে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম সুন্দর দেশ, উন্নত দেশ, সমৃদ্ধশালী দেশ, আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন একটি দেশ হিসেবেই আমাদের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করবে। দেশকে এগিয়ে নিতে শত বছরের ডেল্টা প্ল্যান করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নতি, অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য গতিতে যেন এগিয়ে যায়, সেটাই আমরা চাই। রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হচ্ছে রূপপুর প্রকল্প। রুশ পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক এলেক্সি লিখাচেভ বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ নির্মাণ বেশ জটিল একটি বিষয়। রুশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার প্রাণ ভিভিইআর রিঅ্যাক্টর। যেটি রূপপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রূপপুরের কারণে ২০ হাজার কর্মসংস্থান হবে। এটি শুধু স্থানীয় জীবনমানই পরিবর্তন করবে না বরং জিডিপি বৃদ্ধিতেও অবদান রাখবে। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচের এই প্রকল্পে নব্বই ভাগ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একই সঙ্গে আন্তরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রুশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট।

সর্বশেষ খবর