শনিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

নৌকার প্রার্থীদের শঙ্কা দলীয় বিদ্রোহী

নিজস্ব প্রতিবেদক

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার ৪ নম্বর কাকাইলছেও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মিজবাহ উদ্দিন ভূইয়া। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মিজবাহ উদ্দিন ভূইয়া ও তার বড় ভাই নূরুল হক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেন। তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা চলমান। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তির মনোনয়ন নিয়ে পুনঃবিবেচনার আবেদন করেছেন আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধারা। প্রার্থী পরিবর্তন করা না হলে এখানে ‘স্বতন্ত্র’ (বিদ্রোহী) প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তৃণমূলের তালিকায় রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দিন। তিনিও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে আশরাফ উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিজবাহ উদ্দিন ভূইয়া ও তার বড় ভাই নূরুল হক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকায় অনেক অপকর্ম করেছেন। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলা রয়েছে। যে স্বাধীনতা বিরোধীদের হারিয়েছি ৭১ সালে, সেই স্বাধীনতা বিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর নৌকার মাঝি হতে পারে না। আমরা দলীয় সভানেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যুদ্ধাপরাধীকে বাদ দিয়ে যাকে মনোনয়ন দেবে-আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তা মেনে নেব।’ তিনি বলেন, দলীয় নেতা-কর্মী এবং এলাকাবাসীর চাপে নির্বাচনে অংশ নিতে পারি। 

শুধু আজমিরীগঞ্জ উপজেলার ৪ নম্বর কাকাইলছেও নয়, এমন পরিস্থিতি দ্বিতীয় ধাপের অনেক ইউনিয়ন পরিষদের হয়েছে। নানা কায়দা নৌকা হাতিয়ে নিলেও তৃণমূলের মন জয় করতে পারছেন না অনেক চেয়ারম্যান প্রার্থী। ফলে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হবে দলের বিদ্রোহীরা। মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়া, এমপিদের প্রভাব বিস্তার, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে আত্মীয়করণ, হাইব্রিড-অনুপ্রবেশকারীদের মনোনয়ন দেওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে ফাইনাল ভোটযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই নিজ দলের বিদ্রোহীদের নিয়ে শঙ্কা শুরু হয়েছে নৌকার প্রার্থীদের। স্বতন্ত্র প্রার্থীর নামে বিএনপি যদি অংশ গ্রহণ করে এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে থাকলে ক্ষমতাসীনদের ভোট ভাগাভাগি হবে। মাঝখান থেকে ফলাফল অন্যদের ঘরে যাওয়ার শঙ্কাও আছে।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাসুদ আলম। তিনি নৌকা পাননি। এখানে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম। সেলিমের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে পুনরায় দলীয় মনোনয়ন না দিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন একই ইউনিয়নের যুবলীগের আহ্বায়ক বাবু পুলক ভুইয়া। কিন্তু সেই সেলিম আবারও নৌকার মাঝি হন। এতে ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। দলীয় নেতা-কর্মীদের চাপে মাসুদ আলম স্বতন্ত্র (বিদ্রোহী) প্রার্থী হিসেবে মাঠে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই নেতা-কর্মীরা আমাকে প্রার্থী হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। দীর্ঘদিনের রাজনীতি, এলাকাবাসীর চাওয়াকে আমি ফেলতে পারব না। সুষ্ঠু ভোট হলে, কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না হলে আমি বিজয়ী হব ইনশাআল্লাহ।’ মাসুদের দাবি এলাকার ৯০ শতাংশ নেতা-কর্মী তার পক্ষে রয়েছেন। 

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং একাধিকবার নির্বাচিত ইউপি সদস্য আবদুর রউফ মুকুল। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য কেন্দ্রে আবেদন করেছি। যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাকে জনগণ মেনে নিচ্ছে না। তিনি এর আগে নৌকা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে নেতা-কর্মীদের দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি। তাই এবারে মনোনয়ন পরিবর্তন না হলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নেত্রকোনার হালুয়াঘাট উপজেলার গাজিরভিটা ইউনিয়নে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। তিনি গতবার নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবার মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন দেলোয়ার হোসেন।

রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নে নৌকা পেয়েছেন বেলাল উদ্দিন। এখানে দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন টানা তিনবারের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান। স্থানীয়ভাবে তার নাম এক নম্বরে থাকলেও মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। জানতে চাইলে গোদাগাড়ির দেওপাড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমি টানা তিনবারের চেয়ারম্যান। তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে যে তালিকা পাঠানো হয় সেখানে আমার নাম এক নম্বরে ছিল। কিন্তু এমপির হস্তক্ষেপ করে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যাকে মনোনয়ন দিয়েছে সে বিপুল অবৈধ টাকার মালিক। তার টাকায় আসক্ত হয়েই এমপি মনোনয়ন দিয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর প্রার্থী পরিবর্তনের আবেদন দিয়েছি। আশাকরি কেন্দ্র এসব অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।’

রাজশাহীর তানোরে কামারগাঁ ইউনিয়নে নৌকা পেয়েছেন ফজলে রাব্বী মিঞা। তার এলাকায় জনপ্রিয়তা নেই দাবি স্থানীয় নেতা-কর্মীদের। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মসলেম উদ্দিন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে মসলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমি মনোনয়ন পাইনি এমপির কারণে। তিনিই চিহ্নিত একজন দুর্নীতিবাজকে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এমপির নিজেরই এলাকায় কোনো জনপ্রিয়তা নেই। তাই তিনি জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার দরকার মনে করেননি। যে টাকা দিয়েছে তাকেই প্রার্থী করেছেন।’ একই অবস্থা পিরোজপুরের সদর উপজেলার ১ নম্বর শিকদার মল্লিক ইউনিয়নে নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী ছিলেন থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাওলাদার গোলাম রাব্বানী। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি তার নাম কেন্দ্রে প্রেরণ করেননি। এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ভাঙা মামলার এজাহারভুক্ত এক নম্বর আসামি শহীদুল ইসলামকে নৌকা দেওয়া হয়েছে। যে কারণে হাওলাদার গোলাম রাব্বানীও স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। তার পক্ষে আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ রয়েছে বলে দাবি তার।

৭ নম্বর শঙ্কর পাশা ইউনিয়নেও জনপ্রিয় ব্যক্তির নাম পাঠানো হয়নি কেন্দ্রে। এ নিয়ে দলীয় সভানেত্রীর কাছে সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগ জানিয়েছিলেন খোদ জেলার সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাকিম হাওলাদার নিজেই। এখানে জেলা আওয়ামী লীগে সভাপতি একেএম আবদুল আউয়ালের ভাগিনা এক সময়ের ছাত্রদলের ক্যাডার, উপজেলা যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মল্লিককে নৌকা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বঞ্চিত জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মো. নাসিমর মাতব্বর স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। দলের নেতা-কর্মীরা তারপক্ষে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।

একই উপজেলার ৩ নম্বর দুর্গাপুর ইউনিয়নে গতবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত চেয়ারম্যান চান মিয়া এবারও দলীয় প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার ‘অপরাজনীতির’ বলি হয়েছেন তিনি। সে কারণে বিনা চ্যালেঞ্জে মাঠ ছেড়ে দেবেন না চান মিয়া। নৌকা না পেলেও স্থানীয় নেতা-কর্মীর চাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন ইউনিয়ন নির্বাচনে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর