রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

মনোনয়ন বাণিজ্যের শেষ কোথায়

মাঠপর্যায়ে অভিযোগের শেষ নেই, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে চলছে নানা অসংগতি

রফিকুল ইসলাম রনি

মনোনয়ন বাণিজ্যের শেষ কোথায়

যে কোনো নির্বাচনে ‘নৌকা’ পেলে জয় নিশ্চিত-এমন একটা মনোভাব আছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। মাঠে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকায় দিন দিন এই প্রবণতা দৃঢ় হচ্ছে। সে কারণে যে কোনোভাবে নৌকা পেতে মরিয়া আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। আর এ সুযোগে তৃণমূলে গড়ে উঠেছে মনোনয়ন বাণিজ্য সিন্ডিকেট।

‘যাকে যেভাবে হাত করা দরকার’-এই প্রতিশ্রুতি এবং মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন থেকে। অনেক ক্ষেত্রেই নৌকা বাগিয়ে নিচ্ছেন যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তান, বিএনপি-জামায়াত থেকে হিজরত করা নব্য লীগাররা। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে এমন অভিযোগ আছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। প্রার্থীদের নাম পাঠানোকে কেন্দ্র করে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে চলছে নানা অসংগতি।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের টানা তিনবার চেয়ারম্যান হন আখতারুজ্জামান। তাকে তৃণমূল থেকে এক নম্বরে নাম পাঠানো হয় কেন্দ্রে। কিন্তু স্থানীয় এমপি ‘কলকাঠি’ নাড়ার কারণে তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন বলে দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান বলেন, এলাকায় আমার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ধারণা করছি, টাকা দিতে পারিনি বলেই নৌকা পাইনি। ‘কাকে টাকা দিতে পারেননি বলে নৌকা পেলেন না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ধারণা করছি স্থানীয় এমপি সাহেবই সব নিয়ন্ত্রণ করেছেন।’

দেওপাড়া ইউনিয়নই নয়, মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে আদর্শবিরোধীদের হাতে নৌকা দেওয়ার অনেক অভিযোগ দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে জমা পড়েছে। কিছু কিছু অভিযোগ খতিয়ে দেখে দ্বিতীয় ধাপের ১৩টির মতো ইউনিয়নে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে।

মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে বিতর্কিত ব্যক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, শিবির ক্যাডার, ছাত্রদল-বিএনপি নেতার মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে যেসব অভিযোগ পড়েছে তার অধিকাংশই সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন দলীয় দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে সব অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই অসত্য। একটি ইউনিয়নে একাধিক প্রার্থী থাকায়, যিনি মনোনয়ন পান, অন্যরা তার বিপক্ষে এসব বানোয়াট অভিযোগ আনেন। তবে সবগুলো মিথ্যাও তা বলা যাবে না। মনোনয়ন প্রাপ্ত কেউ কেউ মিথ্যা তথ্যও দিয়েছেন-এটা সত্য। দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড তৃণমূলের মতামত ও বিভিন্ন জরিপের ওপর ভিত্তি করে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। সেখানে মনোনয়ন বাণিজ্যের কোনো সুযোগ নেই।’ রাজশাহীর তানোরে কামারগাঁ ইউনিয়নের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মসলেম উদ্দিন। এলাকায় জনপ্রিয়তাও ছিল বলে দাবি তার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি মনোনয়ন পাইনি এমপির কারণে। তিনিই চিহ্নিত একজন দুর্নীতিবাজকে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এমপির নিজেরই এলাকায় কোনো জনপ্রিয়তা নেই। তাই তিনি জনপ্রিয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার দরকার মনে করেননি। যে টাকা দিয়েছে তাকেই প্রার্থী করেছেন।’

দলীয় সূত্র জানায়, বিগত ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলায় প্রার্থী মনোনয়নের জন্য তৃণমূল থেকে ৩-৫ জনের নাম রেজুলেশন করে পাঠাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল নেতারা সিন্ডিকেট করে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের বঞ্চিত করার অভিযোগ দলীয় সভানেত্রীর কাছে পৌঁছায়। যারা নাম পাঠানোর দায়িত্বে ছিলেন, তারা নিজেদের লোক, এমপির লোকদেরকেই শুধু বাছাই করেনি, অনেক ক্ষেত্রে বিপুল আর্থিক লেনদেনের ঘটনাও ঘটেছে। এসব আর্থিক লেনদেনের তথ্য-প্রমাণ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে এসে পৌঁছায়। ফলে এবার দলের পদ-পদবি থাকলে যে কেউ দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করতে পারবে এমন নির্দেশনা জারি করা হয়। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামত, বিভিন্ন জরিপ খতিয়ে দেখা হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে এখন দল করা ব্যক্তি নয়, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিকই সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। কারণ যারা দুঃসময়ে দল করেছেন, তারা কখনো টাকা দেবে না। আর নব্য হাইব্রিডরা দুই হাতে টাকা বিতরণ করেন। এলাকায় ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচিত হন। এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মনোনয়ন বাণিজ্য শুধু ইউনিয়ন, পৌরসভায় হয়, তা নয়, জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়। যখনই তৃণমূল থেকে নাম চাওয়া হয়েছে, তখনই সেখানে ব্যবসা করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। যারাই নাম পাঠানোর দায়িত্বে, সেসব ব্যক্তিদের টার্গেট করে হালে টাকা হওয়া ব্যক্তিরা। তারা এলাকায় দানশীল সেজে, মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, ক্লাবসহ বিভিন্ন জায়গায় টাকার বান্ডিল বিতরণ করে এলাকায় দানবীর উপাধি নেন। ‘টার্গেটকৃত’ নেতা-কর্মীদের বাড়িতে যাতায়াত বাড়িয়ে দেন। ফলে নব্য লীগাররাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নিজ নিজ এলাকায়।’ ড. মীজানুর রহমান আরও বলেন, ‘ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা এমনকি কেন্দ্রের সঙ্গেও এসব চক্রের যোগাযোগ তৈরি হয়। লবিস্টও নিয়োগ করা আছে। ফলে মনোনয়ন বাণিজ্যের ঘটনা ঘটছে। এসব বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘদিনের দল করা, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের মনোনয়ন দিতে হবে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, তৃণমূলের নেতারা ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় মনে করেন। কারণ তারা সময়ে-অসময়ে টাকা দিতে পারেন। আর এখন মাঠে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকায় নৌকা পাওয়া মানেই বিজয়-এই প্রবণতা থাকায় মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠছে।

মন্দির ভাঙচুরের মামলায় জেলে যাওয়া শহীদুলের হাতে নৌকা : আমাদের পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, চেয়ারম্যান থাকাকালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ভাঙচুর করার অভিযোগে মামলা হয় শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। সে মামলার প্রধান আসামি হিসেবে জেল হাজতেও ছিলেন তিনি। এবারের ইউপি নির্বাচনে তাকেই দেওয়া হয়েছে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা। ঘটনাটি পিরোজপুর সদর উপজেলার সিকদার মল্লিক ইউনিয়নের।

পাঁচপাড়া সার্বজনীন শ্রী শ্রী কালী মন্দির কমিটির সভাপতি সুভাষ মিস্ত্রি জানান, মন্দির ভাঙচুর করার ঘটনায় মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে মামলা করা হয়েছিল। সে মামলায় জেলহাজতে ছিল শহিদুল ইসলাম। তাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে লিখিত আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু তাকেই আবার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে আগামী মঙ্গলবার ইউনিয়নের সব মন্দির কমিটি প্রতিবাদ সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিকদার মল্লিক পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শেখর চন্দ্র মন্ডল জানান, যে আমাদের মন্দির ভেঙেছে, তাকে ভোট দেওয়া সম্ভব না। আবার নৌকা প্রতীকের বাইরেও ভোট দিতে পারব না। তাই এবার ভোট দিতে কেন্দ্র যাব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

সর্বশেষ খবর