শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

আবারও রক্তাক্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প

ভোররাতে মাদরাসায় গুলিতে নিহত ৬, আহত ৯, অস্ত্র-গুলিসহ আটক ১

কক্সবাজার প্রতিনিধি

আবারও রক্তাক্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প

বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়া থাইংখালী আশ্রয় শিবিরের এই মাদরাসায় হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। গতকাল তোলা ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার তিন সপ্তাহের মাথায় আবারও রক্তাক্ত হলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। উখিয়ার ক্যাম্পে একটি মাদরাসায় বেপরোয়া গুলি চালিয়েছে রোহিঙ্গাদেরই সন্ত্রাসী গ্রুপ। নৃশংস এ হামলায় নিহত হয়েছেন ছয়জন। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় চারজনের, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান আরও দুজন। আহত হয়েছেন আরও নয়জন। ভোর রাত ৪টার দিকে উখিয়ার বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ-৫২ ব্লকে অবস্থিত দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদরাসায় এ হামলা হয়। হতাহত সবাই মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। তারা গুলিবিদ্ধ ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হতাহত হয়েছেন। হামলায় জড়িত সন্দেহে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। তার কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতরা হলেন ওই মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মো. ইদ্রীস (৩২) ১২ নম্বর ক্যাম্পে বসবাসকারী, মাদরাসার শিক্ষক নুর আলম ওরফে   হালিম (৪৫) ১৮ নম্বর ক্যাম্পের মোহাম্মদ নবীর পুত্র, মাদরাসার শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫) ২৪ নম্বর ক্যাম্পের রহিমুল্লাহর পুত্র, ভলান্টিয়ার মো. আমীন (৩২) ১৮ নম্বর ক্যাম্পের ব্লক-এইচ/৫২-এর আবুল হোসেনের পুত্র, ওই মাদরাসার দুই ছাত্র ইব্রাহীম হোসেন (২৪) ৯ নম্বর ক্যাম্পের মৃত মুফতি হাবিবুল্লাহর পুত্র ও আজিজুল হক (২২) ১৮ নম্বর ক্যাম্পের নূরুল ইসলামের পুত্র।

কর্মকর্তারা বলেছেন, ময়নারঘোনা পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা বৃহস্পতিবার রাতে স্থানীয় মদুতুল উম্মা মাদরাসা ও আশপাশ এলাকায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ‘ব্লকরেইড’ চালিয়েছিলেন। অন্যান্য ক্যাম্প এলাকায়ও একই সঙ্গে অভিযান চালানো হয়েছে। এর ঘণ্টাদেড়েক পর দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদরাসায় ওই হামলা হয়। ১৮ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি আবদুল মতলব বলেন, ‘ঘুম থেকে উঠে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে কানে আসছিল গুলির আওয়াজ। একপর্যায়ে সবাই বসতঘর থেকে বের হয়ে ছোটাছুটি করছিল। আমিও পেছনের দিকে চলে আসি। পরে গিয়ে দেখলাম সেখানে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন অনেকে। যারা মূলত নামাজরত ছিলেন। কে বা কারা হামলা করেছে তাদের আমরা চিনতে পারিনি।’ স্থানীয়ভাবে পাওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, মাদরাসার মেঝেতে রক্ত ছড়িয়ে আছে। চারদিকে শুধু গুলির চিহ্ন। আর দা দিয়ে কুপিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে টিনের শেড। নিহতদের স্বজনরা সেখানে বিলাপ করছেন। একটি ছবিতে মাদরাসার পাশে কারও হাতে কাটা পড়া দুটো আঙুল পড়ে থাকতে দেখা যায়। হামলার শিকার মাদরাসার প্রধান শিক্ষক মৌলবি দিন মোহাম্মদ বলেন, ‘রাত সাড়ে ৩টায় মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্র মিলে অন্তত ২৫ জন মসজিদে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে যান। এ সময় অস্ত্রধারীরা মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। মসজিদের বাইরে পাহারায় ছিল আরও ৪০ জনের বেশি মুখোশধারী সন্ত্রাসী। গুলির আওয়াজ শুনে সাধারণ রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা এগিয়ে এলে তাদের লক্ষ্য করেও গুলি চালানো হয়।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিডিয়া মোহাম্মদ কামরান হোসেন জানান, ভোররাতের হামলার কথা জানতে পেরে ময়নারঘোনা এপিবিএন পুলিশ ক্যাম্প-১২-এর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের উদ্ধারপূর্বক চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠান। সেখানে চিকিৎসাধীন দুজন রোহিঙ্গা মারা যান। আহত সবাই কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শুধু ১৮ নম্বর ক্যাম্পের নুর কায়সারকে গুরুতর আহত অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ একটি ওয়ান শুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি, একটি ছুরিসহ মুজিবুর রহমান নামে একজনকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, উখিয়া থানা পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে সুরতহাল রিপোর্ট শেষে ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। ঘটনার পর এপিবিএন পুলিশ ও জেলা পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান শুরু করেছে।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো. শিহাব কায়সার খান বলেছেন, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ক্যাম্পে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ নেওয়াজ হায়াত।

২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়া লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ। এ ঘটনার পর থেকেই পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এপিবিএন পুলিশ ও জেলা পুলিশ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এ অভিযানে এ পর্যন্ত অর্ধশত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক হয়েছে।

প্রত্যাবাসন ও আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব : হামলার শিকার মাদরাসা ও মসজিদটি পরিচালনা করে ‘ইসলামী মাহাস’ নামে রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন। রোহিঙ্গাদের দাবি, প্রত্যাবাসন নিয়ে ইসলামী মাহাস নেতাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা বা আল ইয়াকিনের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। সর্বশেষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত সন্দেহে যে অর্ধশত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক হয়েছে তাদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিয়ে ইসলামী মাহাসের নেতারা সাহায্য করেছেন এ ধারণা থেকে ওই মাদরাসা-মসজিদে হামলা চালানো হয়। মসজিদ-মাদরাসাটি দখলের জন্য এর আগেও কয়েকবার হামলা চালিয়েছিল আরসা সদস্যরা। অবশ্য পুলিশ জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা অথবা আল ইয়াকিন নামে কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসা ও আল ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে ওই শিবিরে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর