রবিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

বেপরোয়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা

অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছে ক্যাম্পে আতঙ্কে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা গোষ্ঠী। দিনের আলো নিভে গেলেই তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে ক্যাম্পে। ক্যাম্পের একচ্ছত্র আধিপত্য নেওয়ার চেষ্টায় ভিন্নমত নিশ্চিহ্নের মিশনে নেমেছে তারা। প্রত্যাবাসন নিয়ে সোচ্চার মুহিবুল্লাহর রোহিঙ্গাদের ওপর প্রভাব বাড়তে থাকায় তিনি খুন হয়েছেন এ অস্ত্রধারীদের হাতেই। সহযোগিতা না করায় ও তাদের বিষয়ে তথ্য দেওয়ায়  ব্রাশফায়ারের শিকার হয়ে মাদরাসায় নিহত হয়েছেন ছয়জন। আর দিনের পর দিন অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর। ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা জানাতে পারছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও। এ অস্ত্রধারীদের রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা বলে অভিহিত করলেও পুলিশ জানিয়েছে তারা আরসার নাম ব্যবহার করছে।

শুক্রবার ভোরে অস্ত্রধারীদের গুলিতে নিহত ছয় রোহিঙ্গার লাশবাহী গাড়িতে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে যাওয়া ১৮ নম্বর ক্যাম্পের মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঘোরে, কেউ কিছু বলে না। মাঝেমধ্যে গ্রেফতার হলেও কয়েকদিন পর আবার চলে আসে। তারা প্রকাশ্যে সবাইকে হুমকি দেয়- আরসার বাইরে কেউ কোনো কথা বললে তাকে মাটির নিচে চলে যেতে হবে। ভারী অস্ত্র কাঁধে নিয়ে তাদের চলাফেরা সবাই জানে দেখে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় পুরো ক্যাম্প আরসার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।’ লাশের সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে আপনাদের বললে আমাদের মেরে ফেলবে তাই আমরা খুব ভয়ে আছি।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিহত রোহিঙ্গার আরেক স্বজন অভিযোগ করেন, ক্যাম্পে রাতের অবস্থা খুব ভয়াবহ। দিন শেষে সন্ধ্যা হলেই নিয়ন্ত্রণে নেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। এ গ্রুপটি মিয়ানমারের রাখাইনে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন করে আসছিল একই কায়দায় ক্যাম্পগুলোতেও নির্যাতন চালাচ্ছে। ক্যাম্পগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের বিচরণে ভয়ে রাত কাটে রোহিঙ্গাদের।

এইচ ব্লকের রোহিঙ্গা নেতা মো. ইউসুফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারে রাখাইনদের হাতে মার খেয়ে আশ্রয়ের জন্য এ দেশে পালিয়ে এসেছিলাম। এখন এখানে এসে রোহিঙ্গাদের মার খেতে হচ্ছে। সন্ধ্যার পর ক্যাম্পে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যার পর কী ঘটবে তা-ও আমাদের অজানা। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এখানে বিশেষ করে রাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা দরকার।’ রোহিঙ্গাদের অভিযোগ- অস্ত্রধারী গোষ্ঠীটি পুরো ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করছে। তাদের আলেমদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘উলামা কাউন্সিল’ ক্যাম্পের প্রতিটি মসজিদ-মাদরাসা নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিল। ইতিমধ্যে ক্যাম্পের শতাধিক মাদরাসার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। যেসব মাদরাসা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সেখানে তারা সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। একাধিকবার তারা হামলা হওয়া মাদরাসাটি নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আরসার একাধিক প্রস্তাবেও কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় রোহিঙ্গারা প্রতিষ্ঠানটি তাদের হাতে তুলে দিতে রাজি হননি। এতে ওই ব্লকের রোহিঙ্গা ও মাদরাসা কর্তৃপক্ষের ওপর ভীষণ খেপেছিল আরসার নেতারা। রোহিঙ্গাদের তথ্যমতে হামলার শিকার দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদরাসা ও মসজিদটি পরিচালনা করে ‘ইসলামী মাহাস’ নামে রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন। সংগঠনটি রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়সহ মিয়ানমারে ফেরাতে উৎসাহিত করার কাজ করছে। এ ছাড়া সংগঠনটি রোহিঙ্গাদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। রোহিঙ্গাদের দাবি- প্রত্যাবাসন নিয়ে মাহাস নেতাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা বা আল ইয়াকিনের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত সন্দেহে যে অর্ধশত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক হয়েছে তাদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য দিয়ে মাহাস নেতারা সাহায্য করেছেন এ ধারণা থেকে ওই মাদরাসা-মসজিদে হামলা চালানো হয়।

অবশ্য পুলিশ জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসা অথবা আল ইয়াকিন নামে কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসা ও আল ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে। অন্যদের ধরতে ওই শিবিরে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে।

আতঙ্কে স্থানীয় বাংলাদেশিরাও : অস্ত্রধারীদের আধিপত্য কিংবা সন্ত্রাসকাে র কারণে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আশপাশে বসবাসরত স্থানীয়রাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। উখিয়ার ক্যাম্প ১৮-এর পাশে বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দা কবির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে আমরা শান্তিতে নাই। মানবিক কারণে এ দেশে তাদের স্থান দেওয়া হলেও এখন আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। প্রতিনিয়ত তাদের হুমকি-ধমকির মধ্যে রয়েছি। রাতের পর রাত গুলির শব্দ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে।’ কুতুপালং ক্যাম্পের পাশে বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দা জামাল হোসাইন বলেন, ‘আমার বাড়ি কাঁটাতারের বাইরে। অথচ এখানে এসেও রোহিঙ্গারা মাস্তানি করে। গাছ থেকে নারকেল, সুপারি পেড়ে নিয়ে যায়। হাঁস-মুরগি ধরে নিয়ে যায়। আমরা কিছু বললে বাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়ে। বলতে গেলে তাদের কাছে আমরা অসহায়। তাদের মারামারি, মুখোমুখি সংঘর্ষ আমাদের আতঙ্কে রাখে।’ উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসকা , অপরাধ, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুম, মাদক পাচার, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপর্কমে জড়িত থাকার যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। দিনের পর দিন তারা স্থানীয়দের ওপর হামলা করছে। স্থানীয়দের গুম করে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। তাদের কাছে স্থানীয়রা নিরাপদ নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ক্যাম্পগুলোর আশপাশে স্থানীয়দের বসবাস অযোগ্য এবং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর