রবিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

কুমিল্লায় ইকবালসহ চারজন রিমান্ডে, ১৩ জন গ্রেফতার নোয়াখালীতে

কুমিল্লা ও নোয়াখালী প্রতিনিধি

কুমিল্লা মহানগরীর নানুয়ার দীঘির পাড়ের একটি অস্থায়ী পূজামন্ডপে কোরআন শরিফ রাখার অভিযোগে গ্রেফতার ইকবাল হোসেনসহ চারজনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। হিন্দু-মুসলিম উভয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে দুপুর ১২টায় কুমিল্লা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের তোলা হয়। পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। বিচারক মিথিলা জাহান নিপা সাত দিন মঞ্জুর করেন। এদিকে ভিডিওতে ইকবালকে হনুমানের একটি গদা কাঁধে নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। তবে সে গদাটি একটি পুকুরে ফেলে দেন বলে পুলিশের এক সূত্র জানান। কোন পুকুরে ফেলা হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। অন্যদিকে পূজাম পের ঘটনা ফেসবুক লাইভে প্রচারকারী ফয়েজ আহমেদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ইকবাল ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। অন্যদেরও সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখছি। তারা আরও কোনো ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকলে সেখানেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। যেহেতু এটা স্পর্শকাতর বিষয় তাই তদন্তে সময় লাগবে এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু এখন বলা যাবে না।’ হনুমানের গদাটি কোথায়- জানতে চাইলে তিনি জানান, সেটি ইকবাল পুকুরে ফেলে দিয়েছেন। তবে কোন পুকুরে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার রাতে ইকবালকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার করে শুক্রবার দুপুর ১২টায় কুমিল্লা পুলিশ লাইনসে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

পুলিশ থেকে সংগৃহীত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ১২ অক্টোবর রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে দারোগাবাড়ি মসজিদে প্রবেশ করেন ইকবাল হোসেন। এ সময় মাজারের অস্থায়ী খাদেম ফয়সাল ও হুমায়ুন মসজিদে ছিলেন। ১০টা ৫৯ মিনিটে বেরিয়ে যান ইকবাল। রাত ২টা ১২ মিনিটে পুনরায় মসজিদে প্রবেশ করে দানবাক্সের ওপর থেকে কোরআন শরিফ সংগ্রহ করেন। ২টা ১৪ মিনিটে তিনি বেরিয়ে যান। ২টা ২৭ মিনিটে এসে আবার কোরআন শরিফটি হাতে নেন। এদিক-সেদিক সামান্য পায়চারি করে বেরিয়ে পড়েন। এরপর পূজাম পের দিকে অগ্রসর হয়ে জগন্নাথ মন্দিরের দিকে এগিয়ে যান। তারপর চকবাজারের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক শাখা থেকে পূবালী ব্যাংকের দিকে অগ্রসর হন। তখন রাত ২টা ৪২। এরপর তিনি পূবালী ব্যাংক মোড়ে অবস্থান করেন। তখন ভিডিওতে আরও দুজনকে দেখা যায়। ইকবাল পেছনের দিকে এক হাত রেখে (ওই হাতে কোরআন শরিফ ছিল) তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর এসআইবিএল ব্যাংকের চকবাজার শাখায় অগ্রসর হন। সেখান থেকে চার্টার্ড ব্যাংক। পুনরায় ডিগাম্বরীতলা গুপ্ত জগন্নাথ মন্দির রোডে যাত্রা করেন। মন্দিরের তালা ভাঙার চেষ্টা করেন ইকবাল। কিন্তু ব্যর্থ হন। ওই সড়ক দিয়ে দুই ব্যক্তি অগ্রসর হয়। তারপর ছয়জন, তারপর আরও একজন। এরপর উল্টো দিকে হাঁটা ধরেন তিনি। তারপর জগন্নাথ মন্দির থেকে নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজাম পের দিকে অগ্রসর হন। তারপর দেখা যায় তার হাতে কোরআন শরিফটি নেই। এরপর হনুমানের গদা নিয়ে হাঁটতে থাকেন। দুই মিনিট পর ৯৯৯-এ কল করা ইকরামকে দেখা যায়। এবার আবার দারোগাবাড়ি মসজিদে প্রবেশ কপ্রণ ইকবাল। তখন তার হাতে গদাটিও ছিল না। মসজিদে একজনকে ঘুমাতে দেখা যায়। ১৩ অক্টোবর যখন নানুয়ার দীঘির পাড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে সেখানে উসকানি দিতে দেখা যায় ইকবালকে।

আদালতে ফয়েজের স্বীকারোক্তি : কুমিল্লায় পূজাম পের ঘটনা ফেসবুক লাইভে প্রচারকারী ফয়েজ আহমেদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিথিলা জাহান নিপা ফয়েজের জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ফয়েজ আহমেদ দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। প্রবাসে থাকাকালে প্রতিনিয়ত স্ত্রীর সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বলতেন। এতে মোবাইলে ভিডিওকল ও ভিডিও ফুটেজ ধারণ করতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনি নানুয়ার দীঘির পাড়ের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। পূজাম পে কোরআন শরিফ পাওয়ার খবর শুনেই সেখানে গিয়ে তিনি ফেসবুক লাইভে প্রচার করেন। কিন্তু তার জানা ছিল না এ লাইভে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরি হবে।

গ্রেফতার চারজন সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে : ম পে কোরআন শরিফ রাখেন ইকবাল। কুমিল্লা মহানগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর লস্করপুকুর এলাকার নূর আহম্মদ আলমের ছেলে তিনি। ইকবালের মা আমেনা বেগম জানান, ইকবাল নেশাগ্রস্ত হয়ে নানাভাবে পরিবারের সদস্যদের ওপর অত্যাচার করতেন। বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে হাঁটেন। গোসলখানার দরজা বন্ধ করে ইয়াবা সেবন করেন। ইকবাল মাজারে মাজারে থাকতে পছন্দ করতেন।

৯৯৯-এ কল করেন ইকরাম হোসেন : বুধবার ৯৯৯-এ কল করেন ইকরাম হোসেন (৩০)। ইকরাম মহানগরীর কাঁসারিপট্টির রিকশাচালক বিল্লাল হোসেনের ছেলে। ইকরাম বিবাহিত হলেও অপ্রকৃতিস্থ ও মাদকাসক্ত হওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে। তিনি একজন পাইপমিস্ত্রি। মঙ্গলবার রাতে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে যান। সারা রাত বাইরে থাকেন। সকালে নানুয়ার দীঘির পাড়ে গিয়ে ৯৯৯-এ কল করেন ইকরাম। তারপর পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। সিসিটিভি ফুটেজে ইকবাল মসজিদে যাওয়ার দুই মিনিট পর ইকরামকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়। একটি সূত্রে জানা যায়, ইকরামকে পুলিশ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর পর থেকে পুলিশ হেফাজতে ছিলেন তিনি। তার মা সেলিনা আক্তার বলেন, ‘স্থানীয় বখাটেদের সঙ্গে মিশে আমার ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে।’

সহকারী খাদেম ফয়সাল : মামলায় গ্রেফতার আরেকজন মাজারের সহকারী খাদেম ফয়সাল। তিনি নানুয়ার দীঘির পাড় এলাকার মতিনুর রহমানের ছেলে। ফয়সালরা অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। এখনো বাড়ি ভাড়ার আয় দিয়ে তাদের সংসার চলে।

নোয়াখালীতে ১৩ জন গ্রেফতার : নোয়াখালীর চৌমুহনীতে পূজামন্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে আটজনসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যায় নোয়াখালী পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম পিপিএম নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

পুলিশ সুপার জানান, গত ১৫ অক্টোবর বিকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মন্দির ও পূজামন্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় যুক্তদের ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করা হয়েছে। বেগমগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ড চাওয়া হবে। এ নিয়ে চৌমুহনীর ঘটনায় ১২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং মামলা হয়েছে ১০টি।  ঘটনার পেছনে কারা নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদেরও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।

সর্বশেষ খবর