বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আপিল নিষ্পত্তির আগেই ফাঁসি কার্যকর?

চার বছর আগে যশোর কারাগারে মোকিম ও ঝড়ুর দণ্ড কার্যকর হয় । আপিল শুনানির জন্য কার্যতালিকায় এলে ঘটনা প্রকাশ পায় । বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি । নজিরবিহীন বলছেন আইনজীবীরা । পরিবারের বিস্ময়

আরাফাত মুন্না

আপিল নিষ্পত্তির আগেই ফাঁসি কার্যকর?

চার বছর আগে চুয়াডাঙ্গার আবদুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ু নামে দুই ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর হয়। আপিল শুনানি শুরু হওয়ার আগেই এ দুজনের সাজা কার্যকর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তাদের আইনজীবী। দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এ ঘটনাটি ঘটেছে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ওই দুই ব্যক্তির আপিল আবেদন শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় এলে ঘটনাটি প্রকাশ পায়। গতকাল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ১১ নম্বর ক্রমিকে ছিল মোকিম ও ঝড়ুর আপিল। তবে শুনানি হয়নি। পরে মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবী হুমায়ুন কবির বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন তিনি। এ দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলায় মৃত্যুদন্ড ছিল না বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। মোকিম ও ঝড়ুর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর তাদের দন্ড কার্যকর হয় বলে জানিয়েছেন কারাসূত্র। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে মোকিমের পরিবার। বিচার চেয়েছে এমন অন্যায়ের। আইন অনুযায়ী কোনো আসামির বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ড হলে তা কার্যকরে অনুমতি প্রয়োজন হয় হাই কোর্টের। হাই কোর্টে মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের পর তা কার্যকরে আরও কিছু প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়। তবে হাই কোর্ট কোনো আসামির মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের পর আপিল দায়ের করা হলে আপিল বিভাগ থেকে কারা কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে এ বিষয়ে নির্দেশনা যায়। ফলে দন্ড কার্যকর ওই সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়। আইনজীবী বলছেন, মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে এসব বিধিবিধান মানা হয়নি। ঘটনাটিকে নজিরবিহীন বলছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাও। তারা বলেন, আপিল শুনানি হলে এই মানুষ দুটির সাজা কমতেও পারত। সাজা কমার অনেক নজির রয়েছে। বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। তারা বলেন, আপিল নিষ্পত্তির আগে কীভাবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হলো তদন্তের মাধ্যমে তা বের করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের সত্যতা স্বীকার করেছেন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। যখন মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় তখন জেলার ছিলেন আবু তালেব। বিষয়টি নিয়ে তার বক্তব্য জানা যায়নি। তবে বর্তমান জেলার তুহিনকান্তি খান দাবি করেছেন, দুই আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকরের বিষয়ে উচ্চ আদালতের লিখিত আদেশ তাদের কাছে আছে। দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, সেই নথিও তাদের কাছে আছে।

এদিকে খুলনা বিভাগীয় কারা উপমহাপরিদর্শক মো. ছগির মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা ফাইল পরীক্ষা করে দেখছি।’ মামলার নথি থেকে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন একই এলাকার সাবেক ইউপি মেম্বার মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার চাচাতো ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে মোকিম ও ঝড়ুর নাম আসে। ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ মামলার বিচারে তিনজনকে মৃত্যুদন্ড, দুজনকে যাবজ্জীবন ও অন্য আসামিদের খালাস দেয় চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২। মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন- একই ইউনিয়নের তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাই কোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করে। বাকি আসামিদের খালাস দেয়। পরে মোকিম (আপিল নম্বর ১১১/২০১৩) ও ঝড়ু (আপিল নম্বর ১০৭/২০১৩) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন। মোকিমের পক্ষে আপিল মামলাটি তদারকির দায়িত্ব পান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. হুমায়ুন কবির। এরপর কেটে গেছে আট বছর। দীর্ঘ সময় পর সম্প্রতি মামলাটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ওঠে। মামলাটি শুনানির জন্য তালিকায় ওঠার পর দরিদ্র মোকিমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, আপিল নিষ্পত্তির আগেই ২০১৭ সালে মোকিমের ফাঁসি কার্যকর করেছেন কারা কর্তৃপক্ষ। এমনকি অন্য আসামি ঝড়ুর মৃত্যুদন্ডও কার্যকর হয়েছে। আইনজীবী হুমায়ুন কবির বলেন, ‘মামলার তদারকি করতে গিয়ে আমি নিজেও ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। বিচারপ্রার্থী মোকিম কনডেম সেলে ছিলেন। বিচারপ্রার্থীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছি কনডেম প্রিজনার মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদন্ড ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। মূলত মোকিম ও ঝড়ুর পরিবার খুবই দরিদ্র। তাই তাদের পক্ষে পরিবারের সদস্যরা সেভাবে মামলার বিস্তারিত খোঁজ নিতে পারেননি।’ সে সামর্থ্যও তাদের ছিল না বলে জানিয়েছেন এই আইনজীবী। এদিকে আপিল বিভাগে শুনানির জন্য মোকিমের পক্ষের আইনজীবী মো. আসিফ হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষের দায় রয়েছে। তাই এ ঘটনায় আমরা আপিল বিভাগের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাইব। যাদের অবহেলায় এ ঘটনা ঘটেছে তাদের অবহেলার উপযুক্ত বিচার চাইব। এমন ঘটনা যেন ভবিষ্যতে না ঘটে সেজন্য সর্বোচ্চ আদালতের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাইব। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চাইব।’ জানতে চাইলে মোকিমের স্ত্রী মোছা. ফারজানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার স্বামীর বিরুদ্ধে একটাই হত্যা মামলা ছিল। এ মামলায় চার বছর আগে তার ফাঁসি হয়। মেহেরপুরের ভোলাডাঙ্গা গ্রামে তাকে দাফন করা হয়েছে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আমিও এখানেই থাকি। এখন শুনতেছি মামলা নাকি শেষ হয় নাই। আমাদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।’ ঝড়ুর স্ত্রী আনজিরা বেগম চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধিকে বলেন, ‘নতুন করে ঝামেলায় জড়াতে চাই না। বিষয়টি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’

নজিরবিহীন বলছেন আইনজীবীরা : ঘটনাটি নজরে আনলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘হাই কোর্টের রায়ের পর যদি আপিল আবেদন করার ক্ষেত্রে দেরি হয়ে থাকে অর্থাৎ কনডোনেশন অব ডিলে থাকলে ডিলে (দেরি) মওকুফের জন্য আবেদন করতে হয়। আদালত যদি ডিলে মওকুফ করে আপিল শুনানির জন্য মামলাটি গ্রহণ করে তাহলে আপিল নিষ্পত্তির আগে দন্ড কার্যকরের সুযোগ নেই। কারণ আপিল শুনানি হলে আসামিদের দন্ড কমতেও পারে।’ আপিল শুনানির আগেই আসামিদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ঘটনা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী। তিনি বলেন, ‘এটা চরম অন্যায় হয়েছে। কোনোভাবেই আপিল নিষ্পত্তির আগে কারও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা যাবে না। বিষয়টি হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘কেন, কীভাবে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে তদন্তের মাধ্যমে তা বের করতে হবে। একই সঙ্গে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর