বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতির চেষ্টায় বিশ্বনেতারা

জলবায়ু সম্মেলনে ছয় প্রস্তাব বাংলাদেশের

মাহমুদ আজহার, গ্লাসগো (স্কটল্যান্ড) থেকে

অতিমাত্রায় বৈশ্বিক তাপ থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বনেতাদের নানামুখী কর্মতৎপরতা চলছে গ্লাসগো সম্মেলনে। দফায় দফায় বৈঠক চলছে সম্মেলন ভেন্যুতে। জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমুখী প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতিতে পৌঁছার চেষ্টা করছেন তারা। ১২ নভেম্বর শেষ হবে এ সম্মেলন।

বিশ্বনেতাদের এই মিলনমেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের বেশি শিকার হওয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশে আরও কার্যকরভাবে কীভাবে দাঁড়ানো যায় সেটি নিয়েও আলোচনা চলছে। সম্মেলন শেষে একটি লিখিত ঘোষণা আসবে। এতে স্বাক্ষর করবে সব দেশ। ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে জড়ো হয়েছেন বিশ্বনেতারা। প্যারিসে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সব দেশই কার্যত জলবায়ু ইস্যুতে একমত হয়েছিল। ঘোষণা এসেছিল, সবাই একযোগে কাজ করবে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক হয়েছিল, শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শিল্পায়ন পূর্ব সময়ের ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখবে সবাই। সম্ভব হলে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা হবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আগামী ১২ বছরের মধ্যেই উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়াবে; শতাব্দীর শেষে তা উঠবে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। সেক্ষেত্রে গ্লাসগো সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর চেষ্টা জোরদারের ঘোষণা আসতে পারে। সেটি নিয়েই আলোচনা হচ্ছে।

বড় অর্থনীতির দেশগুলো অবশ্য আগেই কার্বন নিঃসরণ কমাতে নানা ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য প্রথম দেশ হিসেবে কার্বন-নিরপেক্ষ দেশ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে একই ঘোষণা আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকেও। পরে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১১০টির মতো দেশ একই পথে হেঁটেছে। শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ কার্বন-নিরপেক্ষ দেশ হওয়ার লক্ষ্য তাদের। জাতিসংঘের হিসাবে, এই দেশগুলো বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ৬৫ শতাংশের বেশি ও ৭০ শতাংশের বেশি অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে। আর জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশও কার্বন নিঃসরণ কমাতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে অনেকের ধারণা। আয়োজক দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য চায়, সব দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।

কপ-২৬ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা বেশ কিছু মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন বলে জানা গেছে। আলোচনার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, কয়লা, পেট্রোল গাড়ির সমাপ্তি, বন রক্ষা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার সহনশীলতা তৈরির জন্য ১০ হাজার কোটি ডলারের বার্ষিক তহবিলের জোগান।

বাংলাদেশের ছয় প্রস্তাব : সিভিএফ এবং কমনওয়েলথের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার জন্য ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) চেয়ারপারসন ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলন স্থলের কমনওয়েলথ প্যাভিলিয়নে ‘সিভিএফ-কমনওয়েলথ হাই-লেভেল ডিসকাশন অন ক্লাইমেট প্রসপারিটি পার্টনারশিপ’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ প্রস্তাব পেশ করেন।

প্রস্তাবের প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী বলেন,?‘আমাদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ এবং প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অর্জনে আমাদের মধ্যে জ্ঞান ভাগ করে নেওয়া, গবেষণা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর বাড়াতে হবে।’ দ্বিতীয় দফায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অভিন্ন অবস্থান প্যারিস চুক্তিতে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, উন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষ্যে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সুরক্ষিত করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। জলবায়ুু অর্থায়ন হতে হবে বিদ্যমান এবং ভবিষ্যত ওডিএর অতিরিক্ত। এই পরিমাণটি অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে ৫০ : ৫০ অনুপাতের সঙ্গে বরাদ্দ করা উচিত।’ তৃতীয়ত, তিনি বলেন, ‘জলবায়ু অভিবাসীদের সমস্যা-জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটা এবং ঐতিহ্যবাহী পেশা থেকে চ্যুত হয়েছে, যা আলোচনা করা দরকার এবং এসব মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বিশ্বব্যাপী দায়িত্ব নিতে হবে।’ চতুর্থ দফায়, তিনি বলেন, ‘আমাদের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে রাখতে তাদের উচ্চাভিলাষী এবং আগ্রাসী এনডিসি ঘোষণা করতে প্রধান নির্গমনকারী দেশগুলোর ওপর চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে। এ ছাড়া জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা মেটানোসহ সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নয়নশীল দেশগুলেতে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ প্রধানমন্ত্রী তাঁর পঞ্চম দফায় বলেন, ‘একই সঙ্গে সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ সদস্যদের উন্নয়ন চাহিদা বিবেচনায় নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সর্বোপরি একসঙ্গে আমাদের অবশ্যই জলবায়ুু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাস্তবসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থানীয়ভাবে পরিচালিত সমাধানগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘সিভিএফের ৪৮ সদস্য দেশ মোট বৈশ্বিক নির্গমনের মাত্র ৫ শতাংশের জন্য দায়ী। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য মৌলিক হুমকি সৃষ্টি করেছে।’

ষষ্ঠ দফায় তিনি বলেন, অধিকন্তু কভিড-১৯ মহামারী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তিশালী, সাহসী এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপের জন্য কার্যকর সহযোগিতা এবং সহযোগিতার তাৎপর্য প্রমাণ করেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য আমাদের দুর্বলতা এবং প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রধান নির্গমনকারী দেশগুলোকে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের প্রচেষ্টায় সমর্থন করার জন্য তাদের বাধ্যবাধকতা’ পূরণ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর