শনিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

তৃণমূল আওয়ামী লীগে অস্থিরতা

খুনোখুনি চলছেই, এমপিদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ, ছাড় দিতে নারাজ বিদ্রোহীরা

রফিকুল ইসলাম রনি

ইউনিয়ন পরিষদ ভোট নিয়ে অস্থিরতা বাড়ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগে। কেন্দ্র থেকে বারবার হুঁশিয়ার করার পরও বন্ধ হয়নি খুনোখুনি। অভ্যন্তরীণ রক্ত ঝরছেই। গতকাল পর্যন্ত ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৫ জনের প্রাণহানি এবং ৫ সহস্রাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।  শতাধিক সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, হামলা-ভাঙচুর, মামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে।  

দলীয় প্রতীকে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় নৌকার প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন দলের বিদ্রোহীরা। আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউপিতে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা ৭০০। আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ভোটে ১ হাজার ৩টি ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ২ হাজার ৫০০ জন। তৃতীয় ধাপে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা যাবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিশৃঙ্খলা চললেও কিছু কিছু এমপি-মন্ত্রীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে নিজের পছন্দমতো দলীয় প্রার্থী সেখানে বিদ্রোহী মাঠে রাখতে নারাজ তারা। আর যেখানে দলীয় প্রার্থী ‘নিজ বলয়ের’ নয়, সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ইন্ধন দিচ্ছেন তারা। এ বিদ্রোহীর তালিকায় এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনও রয়েছেন। কমিটির মতো ইউনিয়ন ভোটেও এমপি লীগের রাজত্ব চলছে। তৃণমূলে এমপি বলয় এতই ভারী হয়েছে যে, অনেক চেয়ারম্যান প্রার্থী দলের চেয়ে ‘এমপি’কে বেশি ভালোবাসেন। তৃতীয় ধাপে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন আগামী ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। এ উপজেলার নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গত ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহিন আলম সাহাবুর। এবারের নির্বাচনে তিনি দলের কাছে মনোনয়ন চাননি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। এ ব্যাপারে নুরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী সৈয়দ শাহিন আলম সাহাবুর বলেন, ‘আমি বর্তমানে যুবলীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের রাজনীতি করি। তিনি (নিক্সন চৌধুরী) সংসদ নির্বাচনে নৌকা না পাওয়া পর্যন্ত তার একজন কর্মী হয়ে আমি নৌকা চাইতে পারি না।’ একইভাবে মানিকদহ ইউনিয়নের গত নির্বাচনের নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম দলের কাছে মনোনয়ন না চেয়ে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। হামিরদী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোল্লা মো. ফারুক হোসেন গত নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করলেও এবার দলের কাছে মনোনয়ন না চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। গত নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ঘারুয়া ইউনিয়নের সফিউদ্দিন মোল্লা ও আজিমনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতালেব মাতুব্বর। এবার এরাও দলের কাছে মনোনয়ন চাননি। একই সুরে কথা বলেন আজিমনগর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোতালেব মাতুব্বর। এ ব্যাপারে ভাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইফুর রহমান মিরন বলেন, এরা দলীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। 

বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিভাগীয় নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপ ও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপে ভোটযুদ্ধে এখন আওয়ামী লীগই অনেকটা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। দলীয় প্রতীকে বিএনপি ভোট না করায় কোথায়ও কোথায়ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন। বিএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বড় কোনো ঘটনা না ঘটলেও নিজ দলের মধ্যে হামলা-মামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ঘটে চলেছে। কোনো কোনো এলাকায় হাইব্রিড-রাজাকার সন্তান, একাধিক মামলার আসামি, সন্ত্রাসীরা দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় তৃণমূলের চাপে বিদ্রোহী হয়েছেন অনেকেই। এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা নিয়ে সংঘর্ষ-হামলার ঘটনা ঘটছে। থেমে নেই সাধারণ সদস্য (মেম্বার) প্রার্থীরাও।

ভোটের লড়াই থেকে সরাতে প্রতিপক্ষ প্রার্থী ‘মিথ্যা মামলা’ দিতে পারে- দাবি করে আগেই থানায় জিডি করেছেন একাধিক চেয়ারম্যান প্রার্থী। একই সঙ্গে ভোটের মাঠে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কায় নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে বিজিপি, র‌্যাব ও পুলিশ মোতায়েনের দাবি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে লিখিত আবেদনও করা হয়েছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের রাজগঞ্জ ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ আলম। তার অভিযোগ, প্রতিপক্ষ লোকজন তাকে ও তার অনুসারীদের নানাভাবে হুমকি ধমকি ও ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। তাদের নামে নানা মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মাসুদ আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমার আদর্শ, শেখ হাসিনা আমার নেত্রী। আমি আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত কর্মী। মদিনা মনোয়ারায় আমাদের দোকানের নাম জিকরা মোবাইল টেলিকম ও জিকরা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। আমি সৌদি আরবে বৈধভাবে কষ্ট করে আয় করে দেশের মানুষের জন্য খরচ করি। কিন্তু প্রতিপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে বলে বেড়ায় আমরা নাকি জিকরা বাহিনী। আমি জনগণের জন্য কাজ করি। তিনি দাবি করেন, তার প্রতিপক্ষ প্রার্থীর ক্যাডাররা রামদা, কিরিচসহ নানা দেশীয় বেআইনি অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও নানাভাবে তাকে ও তার অনুসারীদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে আগামী ১১ তারিখের নির্বাচনে জনগণই সবকিছুর জবাব দেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। আওয়ামী লীগ প্রার্থী নুরুজ্জামান ভুট্টোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। সূত্র মতে, দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ করা হবে ১১ নভেম্বর। এতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ৭০০ জন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন নিজ এই দলীয় বিদ্রোহীরা। অনেক ইউনিয়নে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন দলীয় প্রার্থীরা। আবার কোথাও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বাড়িছাড়া করা হচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে চট্টগ্রামে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন ২৫ জন। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ৮, বরগুনায় ২, চুয়াডাঙ্গায় ৪, ঝিনাইদহে ১১, পটুয়াখালীতে ১৯, ঢাকার নবাবগঞ্জে ৩০, দিনাজপুরে ২৫, গাইবান্ধায় ২৭, কাপাসিয়ায় ৭, মেহেরপুরে ৩১, মৌলভীবাজারে ১৩, বড়লেখায় ১২, নোয়াখালীতে ৩, নড়াইলে ২১, নেত্রকোনায় ৪২, নীলফামারীতে ১৬, পিরোজপুরে ১০, রাজশাহীতে ৩১, রংপুরে ১০, সাতক্ষীরায় ১৩, চাঁদপুরে ৪, টাঙ্গাইলে ৫, ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীতে ১৪, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় ৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ১১ জনসহ দ্বিতীয় ধাপে ৭০০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৩ ইউনিয়নে ২ হাজার ৫০০ প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তবে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার সুযোগ রয়েছে। আগামী ১১ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তৃতীয় ধাপের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সম্পর্কে জানতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ভোটের প্রচার-প্রচারণা নিয়ে মাগুরা, নরসিংদী, বগুড়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফরিদপুর, ঢাকার ধামরাই, জয়পুরহাট, পটুয়াখালী, বান্দরবান, খাগড়াঝড়ি, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে তৃণমূল আওয়ামী লীগে ততই অস্থিরতা বাড়ছে।

সর্বশেষ খবর