শনিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পুড়ে ছাই পাঁচ শ্রমিক

সোয়ারীঘাটে জুতার কারখানায় ভয়াবহ আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী পুরান ঢাকায় জুতার কারখানার অগ্নিকান্ডে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটে কামালবাগ এলাকায় ‘রুমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে জুতার কারখানায় লাগা ভয়াবহ আগুনের শিখায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে পাঁচটি দেহ। বেশ কয়েক বছর ধরে কারখানাটির শ্রমিক হিসেবে আশপাশের সবার কাছে চেনাজানা মুখগুলো দেখে আর চেনারও উপায় নেই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যদের হারিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে পাঁচটি পরিবারের ভবিষ্যৎ। নিহতরা হলেন- কারখানাটির সেফম্যান মানিকগঞ্জের আমিনুর রহমান (৩৬), জুতার কাটিং মাস্টার বরিশালের মুলাদির আবদুল রহমান রুবেল (৩৫), সিনিয়র জুতার কারিগর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের শামীম মিয়া (৩৫), জুতার কারিগর চাঁদপুরের কচুয়া এলাকার মনির হোসেন (৩৫) ও শেরপুরের শ্রীবরদী এলাকার কামরুল হাসান (২২)।

মৃত মনিরের বোনজামাই মো. শাহজাহান বলেন, মনির ১৬ হাজার টাকা বেতনে ওই কারখানায় চাকরি করতেন। থাকতেন কারখানার একটি কক্ষে। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার কাজ শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঘুমাতে যান। এরপর রাত ১টার দিকে আগুন লাগে। বের হওয়ার দরজায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকায় আর বের হতে পারেননি। মনিরের স্ত্রী নুরুন্নাহার দুই সন্তান মিম (৯) ও বায়েজিদকে (৪) নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। প্রতি মাসে বেতন পেয়ে বাড়িতে ১০ হাজার টাকা পাঠাতেন। ওই টাকা দিয়েই চলত সংসার ও মেয়ের লেখাপড়া। গ্রামের বাড়িতে মায়ের জন্য একটু জমি কেনার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে মৃত কামরুলের। শুধু মনির কিংবা কামরুল নয়, মৃত পাঁচজনের পরিবারেই নেমে এসেছে অন্ধকার। মৃত শামীমের বড় ভাই কাজল মিয়া জানান, লাশ নিতে হলে ডিএনএ টেস্ট করাতে হবে। কারণ লাশগুলো দেখে কোনটা কার সেটি বোঝার উপায় নেই। থানা পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, ডিএনএ টেস্ট করতে ২১-২৩ দিন সময় লাগবে। এখন সেই প্রতীক্ষা শুরু হলো আমাদের।

এদিকে, জুতা তৈরির কারখানাটিতে ড্রামভর্তি কেমিক্যাল, প্রচচুর রাবার জাতীয় কাঁচামাল, প্লাস্টিক ও ডিওপি তেল ছিল। সেখান থেকেই ঘটে আগুনের সূত্রপাত। আর সেই আগুন মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা মদিনা কাঁচাবাজারে। মূলত দাহ্য পদার্থের কারণেই আগুন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস। প্রাণে বাঁচতে ভবন থেকে লাফ দেন দুই শ্রমিক। পরে তাদের উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। লাশও রাখা হয়েছে মিটফোর্ড মর্গে।

সরেজমিন দেখা যায়, কামালবাগে আবাসিক এলাকা থেকে ১৫০ গজ দূরে রুমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের অবস্থান। কারখানার পাশেই ছোট একটি কাঁচাবাজার। বাজারটি মদিনা কাঁচাবাজার নামে পরিচিত। সোয়ারীঘাটের বেড়িবাঁধ সড়কের পাশেই রফিক হাজীর দোতলা কারখানাটি। কারখানাটির দ্বিতীয় তলায় ছিল রাবার ও প্লাস্টিকের কাঁচামালের মজুদ। জরাজীর্ণ ভবনের নিচতলায় ঢুকতেই দেখা যায়, রাখা আছে ডিওপি তেলের অনেক ড্রাম। আগুনে যা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রাবার জাতীয় আঠা ও জুতা তৈরির জন্য রাখা লেদার সেখানে ছিল। আগুনে এসব পুড়ে পাকা ফ্লোর স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। প্লাস্টিক পুড়ে পুরো রুমে ও বাইরে স্তূপে পরিণত হয়েছে।

দোতলায় থাকা রাবারে পানি ছিটানোর কারণে সেটি শক্ত হয়ে প্রলেপ পড়েছে। ফলে ভিতরে পানি ঢুকছে না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মেশিন দিয়ে শক্ত প্রলেপ কেটে পানি ছিটাচ্ছেন। এ ছাড়া ভবনটির দ্বিতীয় তলায় শ্রমিকদের থাকার জন্য করা হয়েছিল খোপ খোপ ঘর। নিহত পাঁচ শ্রমিক ওই ঘরগুলোর একটিতে ঘুমিয়ে ছিলেন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। কারখানা থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে মদিনা বাজারের ১০টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে দোকানগুলোতে থাকা কাঁচা মালামাল ও নিত্যপণ্য পুড়ে ছাই  হয়ে যায়।

মদিনা কাঁচাবাজারের সুপারভাইজার মো. রফিক বলেন, ১০-১২ বছর আগে রফিক হাজী এই জমি লিজ নিয়ে কারখানাটি তৈরি করেছিলেন। কারখানায় অন্তত অর্ধশত শ্রমিক দুই শিফটে কাজ করেন। রফিক হাজী চকবাজারের রহমতগঞ্জের হাজী গলি রোডে বসবাস করলেও তার গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রুমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় বার্মিজ ও স্পঞ্জের স্যান্ডেল তৈরি করা হতো। এই জুতা তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে মজুদ রাখা হতো প্রচুর পরিমাণ কেমিক্যাল, রাবার ও প্লাস্টিক। রাবার একধরনের পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ। ব্যবহার করা হতো দাহ্য ডিওপি তেল। এই তেল জুতা ফিনিসিং ও মোলায়েম করতে সহায়তা করে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের সহকারী উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিটের ২ ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সাধারণত বিভিন্ন জেলা থেকে অল্প শিক্ষিত মানুষরা পুরান ঢাকার এই জুতার কারখানায় কাজ করতে আসেন। কাজের সময় তাদের অনেকে বিড়ি-সিগারেট খান। হয়তো সিগারেট কিংবা কয়েলের আগুনেও এই ঘটনার সূত্রপাত হতে পারে। চকবাজার থানার এসআই উদয়ন বিকাশ বড়ুয়া বলেন, আমরা নিহতদের পরিচয় শনাক্তে কাজ করছি। ডিএনএ টেস্টের পর মৃতদেহগুলো স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর