রবিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

শিশুশ্রমে আটকে যেতে পারে জিএসপি সুবিধা

আইএলও কনভেনশন স্বাক্ষরে সরকারকে তাগিদ পোশাক মালিকদের

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

দেশে শিশু শ্রম বন্ধ না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) জিএসপি সুবিধা আটকে যেতে পারে। এর ফলে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের বাজার হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এখন পোশাক মালিকরা উল্টো সরকারকে তাগিদ দিচ্ছেন যাতে শিশু শ্রম বন্ধে চাকরির ন্যূনতম বয়সসীমাসংক্রান্ত ‘আইএলও কনভেনশন ১৩৮’ স্বাক্ষর করা হয়।

সূত্র জানান, এ বছরের মধ্যেই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশন ১৩৮ অনুস্বাক্ষরের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পরামর্শেই এত দিন শিশু শ্রমসংক্রান্ত কনভেনশনে সই করেনি সরকার। নিজেদের শিল্পকারখানা ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমমুক্ত করতে কিছুটা সময় চেয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে রপ্তানিমুখী ব্যবসা সংগঠনগুলো উল্টো সরকারকে অনুরোধ করছে যাতে দ্রুত কনভেনশনটি অনুমোদন                 দেওয়া হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, একটি দেশে কত বছর বয়সের নিচে কাউকে কোনো শ্রমে সম্পৃক্ত করা যাবে না, সে বিষয়ে আইএলওর একটি কনভেনশন রয়েছে। ১৯৭৩ সালে গৃহীত কনভেনশনের ১৩৮ ধারায় সে বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। যেসব দেশ এ ধারাটি অনুস্বাক্ষর করেছে তাদের তা মেনে চলতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ শিশু শ্রমসংক্রান্ত এ কনভেনশনটি অনুস্বাক্ষর করেছে। এমনকি পাশের মিয়ানমারও গত বছর অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক এ কনভেনশনটি। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এত দিন এ ধারা অনুস্বাক্ষরের বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে সময় চেয়ে আসছিল। তবে এখন এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ ধরনের সময় আর পাওয়া যাবে না। সেজন্য সরকার ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা যাতে পাওয়া যায় সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শ্রম খাতের আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণে বাংলাদেশ কী ধরনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সে বিষয়টি জানতে চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেন, জিএসপি প্লাস সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার, কারখানার নিরাপত্তা, শিশু শ্রম ও সুশাসন বিষয়ে ইইউর প্রশ্ন রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত সাব কমিটির একটি সভা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ওই সভায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে শিশু শ্রমসংক্রান্ত কনভেনশনটি দ্রুত স্বাক্ষরের বিষয়টি। সভায় গৃহীত প্রথম সিদ্ধান্তটি হচ্ছে কনভেনশনটি স্বাক্ষরে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ। কারণ শিশু শ্রম বন্ধ না হলে এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তীতেও জটিলতায় পড়তে হবে বাংলাদেশকে।

ওই সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেখানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছান এলাহী জানিয়েছেন, তাঁর মন্ত্রণালয় থেকে ‘মিনিমাম এজ কনভেনশন ১৩৮’ স্বাক্ষরের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলেও কয়েকটি মন্ত্রণালয় মতামত দেয়নি। সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মতামত না পেলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো আপত্তি নেই ধরে নিয়েই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান ও বিজিএমইএর পরিচালক আসিফ আশরাফ উভয়েই আইএলও কনভেনশন ১৩৮ সমর্থন করে বলেন, এ কনভেনশন অনুমোদনের বিষয়ে ব্যবসা সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সমর্থন আছে। তাঁরা সরকারকে এটি দ্রুত স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান। সূত্র জানান, আন্তর্জাতিক কনভেনশন রেটিফাই না করলেও অবশ্য ২০০৬ সালে করা বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু এ আইন শুধু কাগজে-কলমেই। ওয়েল্ডিং, মোটর ওয়ার্কশপ, যানবাহনের হেলপার, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানা, জাহাজ ভাঙা, বিড়ি-তামাক কারখানা, নির্মাণকাজ, ইট ভাটা, পাথর ভাঙা, অটোমোবাইল স্টেশন, অ্যালুমিনিয়াম, বর্জ্য অপসারণ, কাচ, সাবান, চামড়ার কারখানা, বিস্কুট কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন খাতে শিশু শ্রম বিদ্যমান। অবশ্য সরকার এরই মধ্যে এ ধরনের ৩৮টি খাতে শিশুদের শ্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশু শ্রমমুক্ত করার অঙ্গীকার করেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশু শ্রম বন্ধ না হলে এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তীতে বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে যে জিএসপি প্লাস সুবিধা চাইছে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। নিট পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে গেলে শ্রম ইস্যু, সুশাসন ছাড়াও আমাদের বেশ কিছু শর্ত মানতে হবে। যেমন একটি দেশের মোট রপ্তানির ৮ থেকে ৯ শতাংশের বেশি পণ্য রপ্তানি হলে ইউরোপের বাজারে জিএসপি প্লাস মিলবে না। আমাদের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য ইউরোপ। সেখানে এ শর্তের অনেক বেশি পণ্য রপ্তানি করি আমরা। ফলে সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে দরকষাকষি করতে হবে, যাতে এ ধরনের শর্তের কারণে জিএসপি সুবিধা বাদ না হয়ে যায়। আর শিশু শ্রমের ক্ষেত্রে আমি মনে করি বাংলাদেশের এখন সময় এসেছে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আইএলও কনভেনশন অনুস্বাক্ষর দেওয়া।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর