সোমবার, ৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সাদ তিন দিনের রিমান্ডে, ত্যাজ্য পুত্র করেছিলেন বাবা মা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও চট্টগ্রাম

দেশের শীর্ষ শিল্প পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের চেয়ারম্যান সায়েম সোবহান আনভীরকে হত্যা চেষ্টাকারী সাইফুল ইসলাম সাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়ার আদালত শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করে। এর আগে আসামি সাদকে আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপপরিদর্শক হাসান মাসুদ।

এ সময় ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, ‘আসামি সাদ বসুন্ধরার এমডিকে হত্যার চেষ্টা করেছে। তাই এ হত্যাচেষ্টার পেছনে কাদের ইন্ধন রয়েছে, কারা জড়িত সেটা খুঁজে বের করতে বিষয়টি তদন্তের জন্য আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা একান্ত প্রয়োজন।’ শুনানি শেষে আদালত আসামি সাদের

 তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাউতুল কোরআন মাদরাসা ও এতিমখানা থেকে সাইফুল ইসলাম সাদ নামের এক যুবককে আটক করে পুলিশ। আটক সাদের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। বসুন্ধরার এমডিকে হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত সন্দেহে তাকে আটক করা হয়। শুক্রবার তাকে ৫৪ ধারায় আদালতে সোপর্দ করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাদ জানিয়েছিল, শুক্রবার জুমার সময় সায়েম সোবহান আনভীরের ওপর হামলার প্রস্তুতি ছিল তার। এর আগে তাকে খাবারে বিষ মিশিয়ে এবং ছুরিকাঘাতে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। হুইপ সামশুল হক ও তার ছেলে নাজমুল করিম ওরফে শারুন চৌধুরীর পরিকল্পনা অনুযায়ী দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি হাউসে কাজ নিয়েছিল সাদ। পাশাপাশি সাউতুল কোরআন মাদরাসা ও এতিমখানায় ভর্তি হয়েছিল। এ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন কোরআন খতমের উদ্দেশ্যে বসুন্ধরা এমডির হাউসে যান। সাউতুল কোরআন মাদরাসার অধ্যক্ষ মুফতি মিসবাহ উদ্দিন সগির জানান, কিছুদিন ধরে সাদের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল। ফোনে কথা বলার সময় তার মুখে ‘হুইপ ও শারুন’ শব্দ দুটি শুনতে পেয়ে তিনি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নিরাপত্তাকর্মীদের অবহিত করেন।

বসুন্ধরা গ্রুপের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মেজর (অব.) শেখ মিজানুর রহমান জানান, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হুইপপুত্র বসুন্ধরা গ্রুপের এমডিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এর আগেও কয়েক দফা এ ধরনের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল চক্রটি। এ ঘটনায় মিজানুর রহমান ভাটারা থানায় একটি অভিযোগ করেন। তাতে সাদ ছাড়াও হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও তার ছেলে শারুন চৌধুরীকে আসামি করার আবেদন করা হয়।

উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য ত্যাজ্য করে সাদকে : বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র লিমিটেডের চেয়ারম্যান সায়েম সোবহান আনভীরকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টাকারী সাইফুল ইসলাম সাদ ওরফে জয় দত্ত সম্পর্কে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছোটবেলা থেকেই জয় ছিল উচ্ছৃঙ্খল। কথায় কথায় লোকজনকে মারধর করত। পিতা-মাতার অবাধ্য জয়কে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে চার বছর আগে আদালতের মাধ্যমে ত্যাজ্য করেন তারা। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা জয়ের লাইফ স্টাইলে আসে আমূল পরিবর্তন। ব্যবহার করে দামি মোবাইল ও ব্র্যান্ডেড ঘড়ি। এমন পরিবর্তনে চক্ষু চড়কগাছ স্থানীয়দের। সাইফুল ইসলাম সাদ ওরফে জয় দত্তের বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাছনদ ী গ্রামের দাসপাড়ায় গিয়ে এমন তথ্য পাওয়া যায়। জয় দত্তের পালক মা রীনা দত্ত বলেন, ‘ত্যাজ্য করার পর মাঝে-মধ্যে বাড়িতে আসত জয়। গত কয়েক মাসে একাধিকবার আসে। তার হাতে দেখি দামি মোবাইল ও ঘড়ি। পরনের পোশাকও অনেক দামি মনে হয়েছে। এসব জিনিস কোথায় পেয়েছে তা জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘তার চালচলনে মনে হয়েছে বড় কোনো অপরাধ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। যে আমার ছেলেকে ভুল পথে চালিত করেছে তার ওপর গজব নাজিল হোক।’ পালক বাবা সুজন দত্ত বলেন, ‘জয় ছোটকাল থেকেই উগ্র স্বভাবের ছিল। কথায় কথায় লোকজনকে মারধর করত। নিয়ন্ত্রণ করতে না পেয়ে ১০ বছর বয়সে চট্টগ্রামের একটি সারা দিনের স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ওই স্কুল থেকে এক সময় পালিয়ে যায়। পরে প্রশাসনের সহায়তায় ফেনী থেকে তাকে উদ্ধার করি। তখন জানতে পারি সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা বললেও কখনো তার উগ্র আচরণের পরিবর্তন হয়নি। বরং নেশার টাকার জন্য আমাদের মারধর করত।’ জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি ক্লিনিকের আয়া রীনা দত্ত ১৯৯৯ সালে সাতকানিয়া উপজেলার দোহাজারির কাঠঘর এলাকায় নবজাতক জয় দত্তকে কুড়িয়ে পান। এরপর নিজের সন্তানের মর্যাদা দিয়ে তাকে লালনপালন করতে থাকেন। এক সময় জয় দত্ত নেশাগ্রস্ত এবং অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। নেশার টাকা না পেয়ে পরিবারের লোকজনকে মারধর করতে থাকে। একই সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা বলে এবং ঘরে রাখা মূর্তি ভাঙচুর করে। ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নেশার টাকার জন্য রীনা দত্ত এবং তার স্বামী সুজনকে মারধর করে। এ ঘটনার পর ২০১৭ সালের ১ মার্চ জয় দত্তকে চট্টগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হলফনামার মাধ্যমে ত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়। এরপর নিরুদ্দেশ হয়ে যায় কিছুদিনের জন্য। বছর দেড়েক আগে থেকে ফের বাড়িতে আসা শুরু করে জয়। কিন্তু কয়েক মাস ধরে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন লক্ষ্য করেন এলাকাবাসী। ব্যবহার করতে থাকে দামি মোবাইল, ঘড়ি ও পোশাক। তার উচ্ছৃঙ্খল আচরণের প্রতিবাদ করলে হুমকি দেয় দেখে নেওয়ার। হাছনদ ী গ্রামের দাসপাড়ার ‘হাছনদী ব্রাইট স্টার ক্লাব’ সভাপতি সুমন চন্দ্র দে বলেন, ‘জয় গত দুর্গাপূজার সময় গ্রামে আসে। পিতা-মাতার ঘরে অবস্থান করতে চায়। কিন্তু এতে তারা রাজি না হওয়ায় পালক বাবাকে মারধরের চেষ্টা করে। ক্লাবের সদস্যরা তাদের রক্ষা করায় সবার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। পরে বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে ক্লাবের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেয়।’ স্থানীয় চায়ের দোকানদার নুর নবী বলেন, ‘শুনেছিলাম জয় মুসলমান হয়েছে। পরে তার মা তাকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বলে শুনেছি। পাঞ্জাবিসহ অন্য কাপড় খুলে ধুতি পরে এবং মাথার চুল ফেলে দিয়ে পুনরায় হিন্দু রীতি অনুযায়ী চালচলন শুরু করে। গত মাসে পূজাও করে গেছে।’ একই এলাকার বিধান দে বলেন, ‘গত পূজার আগে বাড়ি এলে দেখা হয় জয়ের সঙ্গে। আলাপচারিতার একপর্যায়ে বলে অনেক বড় বড় নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে তারা কল রিসিভ করেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর